তৃতীয় স্বাধীনতার জন্য তৈরি ছিটমহল

লম্বা দাড়ি নেড়ে বলছিলেন মনসুর শেখ— ‘‘এই নিয়ে তিনটে স্বাধীনতা পেলাম আমরা! আর কেউ পেয়েছে?’’ কী রকম! দু’পাটি মাড়িতে একটা মাত্র দাঁত অবশিষ্ট। তাই নিয়েই খুব হাসছিলেন পোয়াতুর কুঠি ছিটমহলের বাসিন্দা মনসুর মিঞা। খুশিতে ফেটে পড়ছিলেন।

Advertisement

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়

দিনহাটা শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৫ ০৪:১৫
Share:

মনসুর শেখ

লম্বা দাড়ি নেড়ে বলছিলেন মনসুর শেখ— ‘‘এই নিয়ে তিনটে স্বাধীনতা পেলাম আমরা! আর কেউ পেয়েছে?’’

Advertisement

কী রকম!

দু’পাটি মাড়িতে একটা মাত্র দাঁত অবশিষ্ট। তাই নিয়েই খুব হাসছিলেন পোয়াতুর কুঠি ছিটমহলের বাসিন্দা মনসুর মিঞা। খুশিতে ফেটে পড়ছিলেন। বললেন, ‘‘ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা পেলাম পাকিস্তান। সেই একটা স্বাধীনতা। তার পরে পাকিস্তানকে তাড়িয়ে পেলাম আরও একটা। হল বাংলাদেশ। তার পরে কাল আবার স্বাধীন হবো আমরা!’’ আজ আর যেন থামবেন না কিছুতেই। বলে চলেন— আগের দুটো স্বাধীনতা অন্ধকার এনেছে ছিটমহলবাসীর জীবনে। এই স্বাধীনতা আলো আনবে, আলো! তাই ৩১ জুলাইটাই হবে ছিটমহলের আসল স্বাধীনতা। ছেলেমেয়েরা নতুন পরিচয়ে নতুন করে জীবন শুরু করবে।

Advertisement

শুক্রবার মধ্যরাতে যে ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতে মিশে যাচ্ছে, প্রত্যন্ত পোয়াতুর কুঠি তারই একটি। দিনহাটা থেকে দীর্ঘ রাস্তা জামাল শেখের মোটরসাইকেলে পেরিয়ে যখন সে ছিটমহলে পৌঁছনো গেন, সেখানে তখন মোড়ে মোড়ে কমবয়সীদের জটলা। উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে যেন সবাই। কোথা দিয়ে নতুন পাকা রাস্তা যাবে, কোথায় প্রাথমিক স্কুলটি হলে সকলের সুবিধা— এই নিয়েই প্রত্যেকে তাদের কথা বলে যাচ্ছেন। কারও কারও আশঙ্কা— প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র তো হবে, কেউ এই অজগাঁয়ে কাজে আসতে চাইবে তো!

শিবচন্দ্র মুস্তাফি ছিটমহলের বাসিন্দা অনিলচন্দ্র পাল খালি গায়ে বসে ছিলেন বাঁশের মাচায়। কল কল করে কথা বলছেন পাশে বসা সঙ্গীদের সঙ্গে। শুক্রবারের বিশেষ দিনের প্রস্তুতি হিসেবে পাকা চুল কালো করেছেন কলপ দিয়ে। সে দিকে ইশারা করতে লজ্জায় লাল অনিলবাবু। বলেন, ‘‘আমাদের জীবনটা তো অন্ধকারেই কেটে গেল! পরের প্রজন্ম যদি স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে কিছু করতে পারে।’’ বিষ্ণু বর্মণের বয়স অল্প। কোন ক্লাসে পড়ে? ক্লাস নাইনের পরে পড়া ছেড়ে দিয়েছে সে। কেন? অন্যকে অভিভাবক সাজিয়ে, ভুল ঠিকানা দিয়ে পড়াশোনা করার সমস্যা বহু। অনেকে শাসায়— তুই বাংলাদেশি, পুলিশে ধরিয়ে দেব!

বিষ্ণু বলে, পড়াশোনা ছেড়ে বিদেশে গেলাম কাজ করতে। জানতে চাইলাম, কোথায়? বললল, বেঙ্গালুরু। সেটা বিদেশ? উত্তর এল— ইন্ডিয়া তো! কী কাজ? বিষ্ণু বলে, ‘‘আমরা সকলেই রাজমিস্ত্রির কাজ জানি।’’ তা হলে ফিরে এলে কেন? সেখানেও নিত্য সমস্যা পরিচিতি পত্রের।

ঘাড় নাড়ল জামাল— এখন তো একটা আইডি কার্ড ছাড়া রেলের টিকিটও কাটা যায় না। মশালডাঙা ছিটমহলের বাসিন্দা জামালও মাধ্যমিকের পরে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। কারণটা একই— পরিচিতি নিয়ে অনিশ্চয়তা। সে-ও বিদেশে কাজ করতে গিয়ে ফিরে এসেছে। তার বিদেশ রাজস্থান। কেনয সব মসয় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়— এই না ধরে ফেলে বিদেশি বলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়।

আমির শেখের মতো পাঁচ জনের আবার অন্য কাহিনি। বিএএসএফ তাদের ধরে অকথ্য নির্যাতন চালায় বাংলাদেশি বলে। তার পরে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করে দেয়। সেখান থেকে অনেক কাটখড় পুড়িয়ে তারা মশালডাঙ্গায় ফেরে। সেই পাঁচ জনই কিন্তু বারতের নাগরিকত্ব নিতে এক বারও ভাবেনি। কেন? আমিরের কথায়— ‘‘বিএসএফের নয়, দোষ তো আমাদের নসিবের! ভারতের নাগরিক হলে আমাদের এই নির্যাতন সইতে হতো না।’’

সেই সুযোগ মিলতে চলেছে বাংলাদেশি ছিটমহগুলোতে। শুক্রবার মধ্যরাতে ৫১টি ছিটেই তাই ভারতের পতাকা তোলা হবে মধ্যরাতে। সর্বত্র তার তোড়জোড়। তৃতীয় স্বাধীনতা পালনের প্রস্তুতি। ছিটমহলবাসীদের কথায়— আসল স্বাধীনতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন