তৃণমূল সাংসদের মুখে বিরোধীদের ‘রেপ করিয়ে’ দেওয়ার হুমকি শোনার পরে কেটেছে ষোলো দিন। তার পর থেকে সিপিএম সমর্থক পরিবারের মহিলারা শৌচকার্যে একা বেরোতে ভয় পাচ্ছেন, রাতে ঘরের আলো জ্বালিয়ে রাখছেন, অন্ধকার নামলে ঘরবন্দিই থাকছেন। কিন্তু স্থানীয় পঞ্চায়েত সিপিএমের দখলে এবং সিপিএম সমর্থিত নির্দল উপপ্রধানের বাড়ি গ্রামে হলেও মঙ্গলবার পর্যন্ত অভিযোগ এবং প্রতিবাদের রাস্তাতে হাঁটেনি নাকাশিপাড়ার চৌমুহা গ্রাম।
কেন?
মঙ্গলবার গ্রামে গিয়ে শোনাগেল, পুলিশের সামনে দাঁড়িয়েই হুমকি দেন তৃণমূল সাংসদ। লোকসভা ভোটের পরে এলাকায় রাজ্যের শাসক দলের প্রতিপত্তিও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ষাঁড়ের গলায় ঘন্টি বাধার ঝুঁকি কেউই নিতে চাইছেন না।
চৌমুহা যে পঞ্চায়েতের অন্তর্গত, সেই বিক্রমপুরে ২১টি আসনের মধ্যে ১১টি সিপিএমের দখলে, আটটি তৃণমূলের দু’টি কংগ্রেসের। কিন্তু পঞ্চায়েতের রাশ বামেদের হাতে থাকলেও চৌমুহার বাসিন্দা সিপিএম সমর্থিত নির্দল উপপ্রধান মিরন আলি শেখ বলছেন, “সাংসদ তো বিরোধীদের রিভলভার থেকে গুলি করে মারার হুমকি দিয়ে গিয়েছেন। এই এলাকায় শাসক দলের এখন যা রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, তার পরে ওই মন্তব্যে ভয় না পেয়ে উপায় নেই। এখনও সেই ভয় কাটেনি।”
ভয়ের চেহারাটা ফুটছে গ্রামের প্রাথমিক স্কুল লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা মাঝবয়সী মার্জিয়া বিবির গলায়, যিনি বললেন, ‘‘সূর্য ডুবলেই ঘরবন্দি হয়ে পড়ছি। শৌচকার্যেও একা বাইরে বেরোতে ভয় লাগছে।’’ পূর্বপাড়ার বাসিন্দা পঞ্চার্শোধ্ব রাহেবা বিবি তাঁর ভাঙাচোরা ঘরের দাওয়ায় বসে বললেন, ‘‘সাংসদ বলেছেন এলাকায় ছেলেদের ঢুকিয়ে খারাপ কাজ (রেপ) করাবেন। তার পর থেকেই যেন তৃণমূলের লোকজন বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। ভয়ে সারারাত ঘরের বাইরের ও ভিতরের আলো জ্বালিয়ে রাখছি।’’ গ্রামের চার পাড়ার সব জায়গায় বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা নূরজাহান বিবির ঘর এখনও বিদ্যুৎবিহীন। গৃহবধূটি বলছেন, “সাংসদ হুমকি দেওয়া ইস্তক সূর্য পাটে গেলেই ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছি।”
প্রতিবাদ করছেন না কেন, জানতে চাওয়ায় খিঁচিয়ে উঠলেন মহিলারা। জবাব এল, “শাসক দল বলে কথা। ওরা কত কী করতে পারে! প্রতিবাদ করলে বাঁচাবে কে?” কিন্তু পঞ্চায়েত তো এখনও বামেদের দখলে, এমনকী, লোকসভা ভোটেও এই পঞ্চায়েতে সিপিএমের থেকে তৃণমূল পিছিয়ে ছিল? তা হলে বামেরা কেন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পথে হাঁটছেন না? নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একাধিক সিপিএম নেতার বক্তব্য, “এই পঞ্চায়েত এলাকায় পিছিয়ে থাকলেও তাপসবাবুই কৃষ্ণনগরে জিতেছেন। ওঁরা কি এ বার ছেড়ে কথা বলবেন?”
এলাকাবাসীর দাবি, গত ১৪ জুন শুধু চৌমুহা নয়, আরও পাঁচটি গ্রামে পুলিশের সামনেই বিরোধীদের বঁটি দিয়ে খুন করা, কুড়ুল দিয়ে কাটা, গুলি করে মারার মতো হাড়-হিম করা হুমকি দিয়েছেন সাংসদ। সে সব শুনেও পুলিশ দিব্বি চুপ করে ছিল এবং রয়েছে। এর পরে বিরোধিতার রাস্তায় হাঁটার কথা ভাবতে ভরসা পাচ্ছেন না তাঁরা। যাঁর আমলে ওই ঘটনা, নদিয়ার সেই সদ্যপ্রাক্তন পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিশ্র, “এ বিষয়ে একটিও মন্তব্য করব না” বলে ফোন রেখে দেন।
তবে মঙ্গলবার নাকাশিপাড়া ব্লক বিজেপি-র তরফে তাপস পালের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে থানায়। অভিযোগপত্রে লেখা হয়েছে, ‘‘তাপস পালের ওই কুকথায় আমরা আতঙ্কিত। ওঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হোক।’’ পুলিশ ওই অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন জানতে চাওয়া হলে নাকাশিপাড়ার ওসি রাজা সরকার বলেন, “ওই অভিযোগকে এফআইআর হিসাবে গণ্য করার নির্দেশ আসেনি উপরমহল থেকে। তাই আমরা প্রাথমিক ভাবে বিষয়টা নিয়ে তদন্ত করছি।” এ দিনই জেলায় দায়িত্বভার নেওয়া বর্তমান পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “কী বলব! আমি নিজেই তো ব্যাপারটা নিয়ে খোঁজ নিচ্ছি এখন।”