প্রতীকী ছবি।
কলেজ ভবনে মাইক বাঁধা রয়েছে ঠিকই। তবে গত মঙ্গলবার দুপুরে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়েও কোনও ঘোষণা কানে এল না। গেটের সামনে বেশ কয়েকটা মোটরবাইক। সেখানে বসে বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণী। কাছাকাছি গেলেই জানা যাবে, এঁরা কলেজের ‘দাদা-দিদি’ বলেই পরিচিত। কখনও মোটরবাইকে আসীন, কখনও তাঁরা ঝটিতি ঘুরে আসছেন ইউনিয়ন রুম থেকে। আর মাঝেমধ্যেই তাঁদের শরণাপন্ন ভর্তি হতে আসা ছাত্রছাত্রীরা।
উত্তর কলকাতার শঙ্কর ঘোষ লেনে বিদ্যাসাগর কলেজে চলছে ভর্তির কাউন্সেলিং। কলেজের গেটে মোটরবাইকবাহিনীর আশপাশে দাঁড়ানোর কিছু পর ভিতর থেকে এলেন এক দাদা। জানানো গেল, বিএ, জেনারেলে ভর্তি হতে চান বোন। সে জন্যই আসা।
‘‘তালিকায় কত নম্বরে? নাম কী? ইভনিংয়ে ফর্ম ফিল-আপ করা আছে?’’ দাদার প্রশ্ন। ‘‘না, শুধু ডে-সেকশনের ফর্ম ফিল আপ করা হয়েছে।’’
‘‘খরচ বেশি হবে।’’ কত? উত্তর এল, ‘‘২৫-৩০ হাজার মতো। ইভনিংয়ে হলে পাঁচ হাজার কম পড়ত।’’ পরদিন কী ভাবে যোগাযোগ হবে? দ্রুত নিজের নম্বর দিলেন দাদা। বললেন, ‘‘বিদ্যাসাগর কলেজ নামে সেভ করে রাখুন।’’ ‘মিসড কল’ পেয়ে নিজের ফোনে তা ‘সেভ’ও করলেন।
কলেজের ভর্তি নিয়ে গেটে এমন কাজকারবার চললেও কর্তৃপক্ষের জবাব মেলেনি। অধ্যক্ষ গৌতম কুণ্ডুকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। টেক্সট মেসেজেরও উত্তর দেননি।
শ্যামবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজভবনে বাঁধা মাইকে অবশ্য ঘোষণা হচ্ছিল, ‘কোনও প্ররোচনায় পা দেবেন না। মেধাতালিকা অনুযায়ী ভর্তি হবে’। কলেজে গেটের সামনে জটলা সরাতে তৎপর পুলিশকর্মীরা। ভর্তির ভিড় মেট্রো স্টেশনের মধ্যেও পৌঁছছে। নথিপত্র দেখাতে পারলে তবে কলেজের ভিতরে ঢুকতে পারছেন পড়ুয়ারা। বাইরে অপেক্ষা অভিভাবকদের।
তবে এখানেও কলেজের গেট থেকে কয়েক হাত দূরেই গলিতে কয়েকটি মোটরবাইক-স্কুটার।
তাতে হেলান দিয়ে কয়েকজন তরুণ-তরুণী। আশপাশের জটলা বলছে, তাঁরা ‘প্রভাবশালী’। কাছে গিয়ে দেখা গেল, অভিভাবককে নিয়ে পড়ুয়ারা আসছেন টুকটাক। এক ছাত্র এলেন। ইংরেজি অনার্সে ভর্তি নিয়ে কথা শুরু হল এক তরুণীর সঙ্গে। নিতান্ত নিম্ন স্বরে নয় অবশ্য। নম্বর কত? অভিভাবক তা জানাতে বলা হল, ‘হয়ে যাবে’। বেশ কিছু ক্ষণ কথার পর বোঝা গেল, অঙ্কটা প্রায় ৫০ হাজার। পাশে মোটরবাইকে বসা তরুণের সঙ্গে আরেক অভিভাবকের দর কষাকষি তখন চলছে। কানে এল, ‘‘আপনি না দিলে অন্য কেউ দেবেন।’’
কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফে যে মাইকে সমানে বলা হচ্ছে, প্ররোচনায় পা দেবেন না। মোটরবাইক বাহিনীর একজন বললেন, ‘‘ওসব রেকর্ড করা। কান দেবেন না।’’ অধ্যক্ষ মন্টুরাম সামন্ত অবশ্য বললেন, ‘‘আমরা বারবার মাইকে ঘোষণা করছি, প্ররোচনায় পা দেবেন না। তারপরেও যদি ভর্তির জন্য অভিভাবকেরা কাউকে টাকা পয়সা দেন! কলেজের বাইরের বিষয়ে আমরা দেখতে পারব না। পুলিশ-প্রশাসনকে দেখতে হবে।’’
বছর গড়ালেও রাজা নবকৃষ্ণ দে স্ট্রিটের জয়পুরিয়া কলেজে পুলিশকর্মীরা থাকেন। আছেনও। গেটের খানিকটা দূর থেকেই
জটলা সরিয়ে দিচ্ছেন পুলিশকর্মীরা। সেই ভিড়টা চলে যাচ্ছে কিছুটা দূরে।। এক পড়ুয়াকে নিয়ে কলেজ গেটের সামনে এলেন এক অভিভাবক। কাউকে না পেয়ে দ্বারস্থ হলেন এক পুলিশকর্মীর। সেই সময়ে কলেজের ভিতর থেকে হাজির এক তরুণ। অভিভাবককে তাঁর সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করলেন পুলিশকর্মী। গলা উঁচিয়ে তরুণ বললেন, ‘‘এ বার কোনও অফলাইন নয়। সবই অনলাইন।’’ কয়েক মিনিট পরই অবশ্য ছবি বদলাল। কথা শুরু হল তরুণ এবং অভিভাবকের। শোনা গেল, ‘‘করা যেতে পারে। কিন্তু টাকা ছাড়া কিছু করার নেই।’’
কলেজের অধ্যক্ষ অশোক মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘মেধা তালিকা অনুযায়ী ভর্তি হবে। পুলিশ তো সারাক্ষণই পাহারা দিচ্ছে। কেউ যদি লোভের ফাঁদে পা দেন, তাহলে আর কী বলা যেতে পারে।’’
(চলবে)