জলপাইগুড়ির সার্কিট বেঞ্চ।—ফাইল চিত্র।
ফের কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত। এ বার বিতর্কের কেন্দ্রে জলপাইগুড়ির সার্কিট বেঞ্চ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ, শুক্রবার জলপাইগুড়িতে এসে সার্কিট বেঞ্চ উদ্বোধন করবেন, এই সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার শেষ মুহূর্তে রাজ্যকে জানানো হয়েছে। রাজ্য সরকারকে কিছুই না-জানিয়ে এমন আচমকা সিদ্ধান্ত ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক’ বলে মনে করছে নবান্ন। আর তাতেই বেধেছে সংঘাত।
গত বছর ১৭ অগস্ট এই সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধন করা হবে বলে ঠিক হয়েছিল। কলকাতা হাইকোর্ট থেকেও এ বিষয়ে সম্মতি দিয়ে প্রস্তাব নেওয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক হস্তক্ষেপ করে জানায়, বেঞ্চের এক্তিয়ারে কোন এলাকা থাকবে, তা নিয়ে রাজ্যের বিজ্ঞপ্তি যথাযথ নয়। ফলে আটকে যায় উদ্বোধন।
প্রায় পাঁচ মাস পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের ৪৮ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সার্কিট বেঞ্চকে অনুমোদন দিয়েই থামেনি, শুক্রবার ময়নাগুড়ির জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী সেই সার্কিট বেঞ্চ উদ্বোধন করবেন বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়। এখানেই আপত্তি রাজ্যের। তাদের দাবি, এ বিষয়ে রাজ্যকে কোনও তথ্যই দেওয়া হয়নি।
বিষয়টির তীব্র ‘নিন্দা’ করে কেন্দ্রকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। বিষয়টিকে ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক’ বলে তাঁর হুঁশিয়ারি, রাজ্যকে এড়িয়ে বেঞ্চের কাজ শুরু করা যাবে না।
প্রধানমন্ত্রী যে ময়নাগুড়ির মঞ্চ থেকে সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধন করবেন, তা বৃহস্পতিবার শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে বসে জানতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আসা তাঁর সফরসূচি দেখে বিষয়টি প্রথম জানা যায়। সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে প্রতিবাদ করার জন্য মুখ্যসচিব মলয় দে ও স্বরাষ্ট্রসচিব অত্রি ভট্টাচার্যকে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। দৃশ্যতই অসন্তুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চেই দফায় দফায় আলোচনা করে চিঠির খসড়া তৈরি করতে বলেন। স্বরাষ্ট্রসচিব সেই চিঠি সেখান থেকেই পাঠিয়ে দেন কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার সচিবের কাছে। খানিকক্ষণের মধ্যেই রাজ্যের আইনমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন।
তাঁর স্পষ্ট অভিযোগ, ‘‘সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধনের বিষয়ে রাজ্য সম্পূর্ণ অন্ধকারে। রাজ্য সরকারকে আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। এটা বেআইনি। রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘আমরাই সার্কিট বেঞ্চের পরিকাঠামো তৈরির জন্য ৪০ কোটি টাকা খরচ করেছি।’’
দু’টি চিঠি দেখিয়ে আইনমন্ত্রী দাবি করেন, পাঁচ মাস আগে এর উদ্বোধনের জন্য রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রককে চিঠি পাঠিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্র জানিয়েছিল, রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়া উদ্বোধন করা যাবে না। গত সেপ্টেম্বরে ফের কেন্দ্রকে চিঠি দিয়ে রাজ্য জানায়, সার্কিট বেঞ্চের পরিকাঠামোর কাজ সম্পূর্ণ। হাইকোর্টের বিচারপতিরা ৩ বার তা পরিদর্শন করেছেন। রাষ্ট্রপতির সম্মতি মিললে ১৭ সেপ্টেম্বর তা উদ্বোধন করতে চায় রাজ্য। অভিযোগ, এর পর থেকেই কেন্দ্র নিশ্চুপ।
নবান্নের কর্তারা জানাচ্ছেন, ‘আইন ও বিচার’ সংবিধানের কেন্দ্র, রাজ্য এবং উভয় তালিকাভুক্ত। কোথাও হাইকোর্ট বা সার্কিট বেঞ্চ তৈরি হলে সেখানে বিচারপতি নিয়োগ কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত। আবার সেই আদালতের কর্মী নিয়োগ রাজ্যের এক্তিয়ার। আদালতের পরিকাঠামো নির্মাণ, জমি, অর্থ দেওয়ার কাজ কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারই করে। রাজ্যের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করে যেতেই পারেন। কিন্তু পরের দিন থেকে তো আদালতের কাজ শুরু হবে না! মলয়বাবুর হুঁশিয়ারি, ‘‘সাধারণ কর্মী, গাড়ি চালক— এই সব নিয়োগই রাজ্যকে করতে হয়। ফলে গায়ের জোরে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করে দিলেও, বেঞ্চ কাজ শুরু করতে পারবে না।’’
রাজ্যের এক শীর্ষ কর্তার কথায়,‘‘আমরা জমি দিয়েছি, আদালত ভবনের পরিকাঠামো তৈরি করেছি। এখন প্রধানমন্ত্রী এসে উদ্বোধন করে যাবেন, এটা শিষ্টাচার নয়। রাজ্য তাই জানিয়েছে, পরে কোনও দিন কেন্দ্র-রাজ্য আলোচনা করে সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধন করা হোক।’’
এ দিকে, বুধবার প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা কলকাতা হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চকে ছাড়পত্র দেয়। দ্রুত অনুমোদনের জন্য তা পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেওয়ায় শুক্রবারই মোদী তার উদ্বোধন করবেন বলে স্থির হয়। এ জন্যই ময়নাগুড়ির সভায় পাশাপাশি দু’টি মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। একটি থেকে সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধন-সহ বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান হবে। অন্যটি জনসভার। এ বিষয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের মন্তব্য, ‘‘বিষয়টি আদালত এবং কেন্দ্রীয় সরকারের। ফলে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।’’