একশো দিনের টাকা বিতর্ক, আপত্তির নেপথ্যে কোষাগারের হাল

একশো দিনের কাজের মজুরির টাকা সরাসরি উপভোক্তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে আগেই আপত্তি জানিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু কেন্দ্র তাতে কান দেয়নি।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৪৪
Share:

একশো দিনের কাজের মজুরির টাকা সরাসরি উপভোক্তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে আগেই আপত্তি জানিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু কেন্দ্র তাতে কান দেয়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার কথা ভাবছেন। রাজ্যকে এড়িয়ে সরাসরি ‘প্রধানমন্ত্রী-উপভোক্তা’ যোগসূত্র তৈরির চেষ্টাকে সংবিধান বিরোধী এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। যদিও প্রশাসনের একাংশের মতে, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতার মূল কারণ হল রাজ্যের বেহাল আর্থিক পরিস্থিতি।

Advertisement

কিন্তু যে টাকা শেষ পর্যন্ত উপভোক্তাদের কাছেই যাবে, তা হাতে পেয়ে রাজ্যের কী লাভ? অর্থ দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক রাজ্যকে তাদের কেন্দ্রীয় কোষাগারে প্রতিদিন ন্যূনতম ‘ব্যালান্স’ রাখতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে টাকার অঙ্কটা ২.৪৮ কোটি। তহবিলে এই পরিমাণ টাকা না থাকলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে অগ্রিম নিতে বাধ্য হয় রাজ্য। অগ্রিম বা ওভারড্রাফট — সব ক্ষেত্রেই চড়া সুদ দিতে হয় রাজ্যকে। ওই কর্তার কথায়। ‘‘কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা বেশ কিছু দিন নিজেদের হেফাজতে রেখে তবে উপভোক্তাদের কাছে পাঠায় রাজ্য। এক প্রকল্পের টাকা এলে তবে ছাড়া হয় আগের প্রকল্পের টাকা। এই ভাবেই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা ধরে রেখে কোষাগারের ন্যূনতম ব্যালান্স ধরে রাখার চেষ্টা হয়। পোশাকি ভাষায় যাকে বলে পজিটিভ ব্যালান্স।’’ অর্থ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, টানা অগ্রিম বা ওভারড্রাফটের ভরসায় সরকার চালানোর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে রাজ্যগুলির মূল ভরসাই হল কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বরাদ্দ করা অর্থ। এখন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ যদি সরাসরি উপভোক্তাদের কাছে যায়, তা হলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অগ্রিম ও ওভারড্রাফটের উপর রাজ্যের নির্ভরতা অনেকটাই বেড়ে যাবে।

Advertisement

একশো দিনের টাকা বিতর্ক

টানাটানির সংসার

অগ্রিম

ওভারড্রাফট

সরাসরি প্রাপককে*

২০১২-’১৩

১২৯ দিন

১৪ দিন

৮৫০৯.০০

২০১৩-’১৪

১৫৩ দিন

১১ দিন

১০২৮১.০০

২০১৪-’১৫

১৬৪ দিন

নেওয়া হয়নি

৯২১.৪৩

*কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা
হিসেব কোটি টাকায়

নবান্নের শীর্ষ কর্তাদের একাংশের মতে, বাম আমলের ঋণের বোঝা টেনে নিয়ে যাওয়া, সেই সঙ্গে দেদার খরচের চাপে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের এখন গলায় কাঁটা বেঁধার অবস্থা। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজে মুখ না-খুললেও অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘পরিস্থিতি মোটেই সুবিধার নয়। গত তিন বছর সরকারের তহবিলে গ়ড়ে ১৫০ দিনও ন্যূনতম অর্থ ছিল না! ওই সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অগ্রিম আর ওভারড্রাফটই ছিল ভরসা। এখন ১০০ দিনের টাকাও সরাসরি উপভোক্তাদের কাছে চলে গেলে কার্যত ধার-দেনার উপরেই সরকার নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে।’’

কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছ থেকে অগ্রিমও যত খুশি নেওয়া যায় না। প্রথম ধাপে এই অগ্রিমকে ‘স্পেশ্যাল ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স’ বলা হয়। যার সর্বোচ্চ পরিমাণ ৮১৮ কোটি টাকা। এর পরেও অর্থের দরকার হলে ‘নরমাল ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স’ হিসাবে বছরে সর্বোচ্চ ৮০০ কোটি টাকা নিতে পারে পশ্চিমবঙ্গ। এতেও না কুলোলে তৃতীয় এবং শেষ ধাপে রাজ্য ‘ওভারড্রাফট’ নেয়। এই খাতে অর্থের কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। তবে কোনও রাজ্য টানা ১৪ দিন ওভারড্রাফটে চললে সেই রাজ্যের সমস্ত ‘সরকারি পেমেন্ট’ বন্ধ করে দেয় আরবিআই। যা এক প্রকার আর্থিক জরুরি অবস্থার সামিল বলেই মনে করা হয়।

‘‘গত তিন বছর গড়ে দেড়শো দিন করে অগ্রিম অথবা ওভারড্রাফট নেওয়া আটকাতে পারেনি রাজ্য,’’ বলছেন নবান্নের এক কর্তা। তার পরে যদি ১০০ দিনের মজুরির টাকাও না আসে, অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়ে পড়তে পারে। ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকা সরাসরি উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছেছিল। সে বছর ১৫৩ দিন অগ্রিম আর ১১ ‌দিন ওভারড্রাফট নিয়ে কোষাগার সামাল দিয়েছিল নবান্ন। পরের অর্থবর্ষে (২০১৪-’১৫) চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হয়। সেই সুপারিশ অনুযায়ী

কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অধিকাংশ টাকাই রাজ্য বাজেটের পরিকল্পনা খাতে চলে আসে। ফলে সে বছর এক দিকে যেমন রাজ্যের পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ এক ধাক্কায় দ্বিগুণ হয়ে যায়, তেমনি সরাসরি উপভোক্তাদের কাছে যায় মাত্র ৯২১ কোটি টাকা। এই সুবিধার জেরে রাজ্যকে কোনও ওভারড্রাফট নিতে হয়নি। ১৬৪ দিন অগ্রিম নিয়েই কাজ চালিয়ে দেওয়া গিয়েছে। ২০১৫-’১৬ আর্থিক বছরেও একই ধারা বজায় ছিল। নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘এখন ১০০ দিনের প্রকল্পে গড়ে বছরে প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা আসে। এই টাকা সরাসরি চলে গেলে পরিস্থিতি খারাপ হতে বাধ্য।’’

আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ বলেই রাজ্য কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে, এ কথা অবশ্য মানতে চাননি পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আর শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘৩৯টি কেন্দ্রীয় প্রকল্প বন্ধ করে সেই আর্থিক দায় রাজ্যের ঘাড়ে চাপিয়েছে কেন্দ্র। এখন আবার মোদী সরাসরি গড়াগড়ি খেতে চাইছেন। ’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন