গাঁধী মূর্তির পাদদেশে তৃণমূলের সংহতি দিবসের অনুষ্ঠানে (বাঁ দিক থেকে) শোভন চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়। রবিবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
রাজ্যের নেতারা তাঁদের সঙ্গে জোটে গররাজি থাকলেও কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বোঝাপড়া’ যে ভালই, তা বোঝাতে এ বার তৎপর হলেন তৃণমূল নেতৃত্ব!
রাহুল গাঁধীর দূত সি পি জোশীকে শনিবারই রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের গরিষ্ঠ অংশ বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী বিধানসভা ভোটে ফের তৃণমূলের হাত ধরতে তাঁরা রাজি নন। বরং, তৃণমূল এবং বিজেপি-বিরোধী কোনও ধর্মনিরপেক্ষ দল অর্থাৎ বামেদের সঙ্গে জোটে তাঁদের আপত্তি নেই। রাজ্য কংগ্রেসের তরফে রাহুলকে এই মত জানানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই রবিবার তৃণমূলের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় দলের ‘সংহতি দিবসে’র মঞ্চ থেকে প্রকাশ্যেই বলে দিলেন, ‘‘সংসদে কংগ্রেসের লক্ষ্যই হচ্ছে, আমরা কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, তা অনুসরণ করা। আমরা কোনও বিলে সংশোধনী আনার কথা বললে ওরাও একই কাজ করে। আমরা বয়কটের কথা বললে ওরাও বয়কট করে!’’
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বার্ষিকী উদ্যাপনে গাঁধী মূর্তির নীচে সমাবেশে লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা সুদীপবাবু ফের সামনে এনে দিয়েছেন বিহার ভোটের পরে নীতীশ কুমারের শপথ থেকে ফেরার পথে বিমানবন্দরে রাহুলের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতার দেখা হওয়ার ঘটনা। রাহুল সে দিন মমতাকে নিজের চার্টার্ড বিমানে কলকাতায় পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন বলেও দাবি করেছেন তৃণমূলের এই বর্ষীয়ান সাংসদ! কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে মমতার সম্পর্ক যে আদৌ শীতল নয়, তা বোঝাতেই রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের নাম না করে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘এই সব নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কী চোখে দেখেন, তা না জেনেই এখানে রাজ্য দফতরে বসে কেউ কেউ কুমন্তব্য করেন!’’
সুদীপবাবুর এ দিনের বক্তব্যকে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের প্রতি তৃণমূলের বার্তা হিসাবেই দেখা হচ্ছে। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য প্রকাশ্যে অহরহ বলছেন, এ রাজ্যে বিরোধীদের কোনও অস্তিত্ব নেই। তাই বিধানসভা ভোটে কারও সঙ্গে জোট ছাড়াই সহজে জিতবেন মমতা। কিন্তু রাজনৈতিক শিবিরের ব্যাখ্যা, কংগ্রেস বামেদের সঙ্গে পরোক্ষ সমঝোতা করে ফেললেও তৃণমূলের পক্ষে পরিস্থিতি খুব সহজ হবে না বুঝে সুদীপবাবুরা এখন অধীর চৌধুরীদের উপেক্ষা করে হাইকম্যান্ডের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ প্রচারের কৌশল নিলেন!
তৃণমূল নেতারা কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সুসম্পর্কের ইঙ্গিত দিলেও রাজ্য কংগ্রেস নেতারা অবশ্য তাতে বিগলিত নন! তৃণমূলের সভার অদূরে ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে কংগ্রেসও এ দিন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে ‘কালা দিবস’ পালন করেছে। বিধান ভবন থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিল শেষে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরের ঘনিষ্ঠ বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী বিজেপি ও তৃণমূলকে একাসনে বসিয়েই অসহিষ্ণুতার জন্য দায়ী করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষই প্রশ্ন করছে, দিদিভাই আর মোদীভাই কি একই পথের পথিক? যাঁরা বাবরি ধ্বংস করেছিলেন, তাঁরা এখন দেশের সরকারে বসে অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছেন। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার আমাদের সভা পর্যন্ত করতে অনুমতি দিচ্ছে না!’’ সাম্প্রতিক কালে বহরমপুর বা নন্দীগ্রামে কংগ্রেসকে সভা করতে বাধা দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে মনোজবাবু বলেন, ‘‘স্বাধীন দেশে সভা-সমাবেশের মতো সাধারণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে বাধা আসছে। এটাও এক ধরনের অসহিষ্ণুতা। আমরা মনে করছি, দু’জনে একই মুদ্রার এ পিঠ-ও পিঠ!’’ তাঁর ওই সুর মিলে যাচ্ছে বামেদের সঙ্গেই! কলকাতায় বিজেপি দফতরের সামনে তো বটেই, রাজ্য জুড়ে যুব কংগ্রেসও মানববন্ধন করেছে।
মেয়ো রোডের সভায় স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী বা তাঁর সাংসদ-ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন না। তবে তৃণমূল নেতাদের সুরেই মঞ্চে উপস্থিত বিভিন্ন ধর্মগুরুও মমতা-বন্দনায় মুখর ছিলেন! টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম নূরুর রহমান বরকতি সংখ্যালঘুদের কাছে বিধানসভা ভোটে মমতার জন্য ভোট-ভিক্ষাও করেছেন এ দিন সভা থেকে। আর সুদীপবাবুর বক্তব্য, ‘‘সংসদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে তো বলেছি, এ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা বদলানোর কথা বলে সংবিধানকে বিকৃত করার চেষ্টা করছেন। এটা লজ্জার!’’ দিল্লি, বিহারের মতো রাজ্যে বিজেপি-র পতন উল্লেখ করে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যে পদ্ধতিতে তারা এ দেশের সহিষ্ণুতাকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করছে, তাতে ভারতের মানুষ তাদের সহজে ছেড়ে দেবে না!’’
বাম-কংগ্রেস যে অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে করছে, সেই রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার দায় পাল্টা বামেদের উপরেই চাপিয়েছেন উত্তর কলকাতার সাংসদ। তাঁর অভিযোগ, ‘‘এরাই তো বাংলাকে অসহিষ্ণু করতে শিখিয়েছে। এরাই লাশকে মাটির নীচে কবর দিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করতে শিখিয়েছে!’’ কিন্তু বদলা নিতে কখনওই তৃণমূল বামেদের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণ করেনি বলে তাঁর দাবি! বামেদের প্রতি সুদীপবাবুর হুঁশিয়ারি, ‘‘জীবদ্দশায় আর তৃণমূলের পরিবর্তন দেখে যেতে পারবেন না আপনারা!’’