বেলঘরিয়ার বাসন্তী পাহাড়ির (নাম পরিবর্তিত) মৃত্যুর কয়েক বছর পরে তাঁর নামে ১৭টি মোবাইলের সিম নেওয়া হয়েছে। সংলগ্ন এলাকারই আর একটি বাড়ির ১৩ জনের নামে রয়েছে ৪৬৮টি মোবাইলের সংযোগ। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, এক জনের নামে ন’টির বেশি মোবাইলের সংযোগ থাকার কথা নয়!
মোবাইল সংযোগে জালিয়াতি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে এ সব দেখে-শুনে চক্ষু চড়কগাছ টেলিকম দফতরের কর্তাদের। তাঁদের বক্তব্য, কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যেই জাল ছড়িয়েছে। যা চিন্তায় ফেলেছে প্রশাসনকে। কারণ জাল সিম বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও নাশকতামূলক কাজেও ব্যবহার করা হতে পারে।
গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ১৫ লক্ষ ভুয়ো মোবাইল সংযোগ কেটে দেওয়ার জন্য মোবাইল সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দিয়েছিল টেলিকম দফতর। সেই তালিকায় সব মোবাইল সংস্থাই রয়েছে। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে ওই অভিযোগ লক্ষাধিক হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা বিএসএনএল-এর ক্ষেত্রে তা কার্যত নগণ্য। এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ভুয়ো সংযোগের জন্য মোবাইল সংস্থাগুলিকে কয়েক কোটি টাকা জরিমানাও করেছে টেলিকম দফতর।
আগে আধার কার্ডের জালিয়াতি করে ভুয়ো সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এখন ভোটার কার্ডের জালিয়াতি করেও সংযোগ নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি দফতরের কর্তাদের। তাঁদের আশঙ্কা, কলকাতা সংলগ্ন এলাকার (কলকাতা সার্কেল) প্রায় ২.৫০ কোটি গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ৫০ লক্ষের সংযোগই ভুয়ো। কোথায় কোথায় এ ধরনের চক্র সব চেয়ে বেশি সক্রিয়, তার তদন্তে নেমে বেলঘরিয়া এবং দমদমের মতো জায়গার নাম উঠে আসে দফতর-কর্তাদের কাছে। শুধু বেলঘরিয়াতেই জালিয়াতির অভিযোগ উঠছে একশোরও বেশি বিক্রেতার বিরুদ্ধে। কর্তারা জানান, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি অভিযুক্ত বিক্রেতাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। তারা যাতে আর কোনও দিন টেলিকম ব্যবসা করতে না পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা।
নিয়ম অনুযায়ী, বিক্রেতার সামনেই আবেদনপত্রের (কাস্টমার অ্যাক্টিভেশন ফর্ম) নির্দিষ্ট জায়গায় গ্রাহকের ছবি লাগিয়ে ছবিতে ও আবেদনপত্রের নীচে তাঁর সই করার কথা। পরিচয়পত্রের নকলেও (ফটোকপি) একই সই করে তা জমা দিতে হয়। এর পর ওই বিক্রেতা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জানান, তিনি ওই ব্যক্তিকে দেখেছেন ও তথ্য যাচাই করেছেন। তার ভিত্তিতেই সংযোগ চালু করে দেয় মোবাইল সংস্থা। টেলিকম দফতরের বক্তব্য, এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই ফাঁকফোকর তৈরি করে ছড়াচ্ছে জালিয়াতির চক্র।
যেমন কখনও হয়তো বিক্রেতার অনুরোধে বা স্বেচ্ছায় গ্রাহক ছবি না লাগিয়ে বিক্রেতার কাছে জমা রেখে দেন। পরে বিক্রেতাই তা লাগিয়ে দেন। ছবিতে বা আবেদনপত্রেও গ্রাহকের ঠিকমতো সই থাকে না। পরে ভুয়ো সংযোগ নেওয়ার জন্য সেই সুযোগকেই কাজে লাগায় জালিয়াতরা। হয় ছবি জাল, নয়তো পরিচয়পত্র জাল করে আসল ব্যক্তির অজান্তেই জালিয়াত চক্র চালু করে লক্ষ লক্ষ ভুয়ো সংযোগ।
আমজনতার প্রতি দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, পাসপোর্ট করানোর মতো মোবাইলের সংযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রেও সব নথিপত্র যে গুরুত্বপূর্ণ, তা গ্রাহকদের মাথায় রাখতে হবে। তাই কারও পরামর্শে কান না দিয়ে নিয়ম মেনে আবেদনপত্র যথাযথ ভাবে পূরণ করুন তাঁরা। পরিচয়পত্র বা ছবিতেও এমন ভাবে গ্রাহকের আড়াআড়ি স্বাক্ষর থাকুক, যাতে কোনও ভাবেই তা নকল করা না যায়। তা না হলে ভুয়ো সংযোগের জন্য তাঁকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে।
কিন্তু নজরদারির অভাব কেন?
সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশের বক্তব্য, এক জন বিক্রেতা যত বেশি সিম কার্ড বিক্রি করবেন বা যত বার সেই মোবাইলে রিচার্জ করা হবে, তত বার তিনি তার কমিশন পাবেন। তা ছাড়া, নতুন গ্রাহক বাড়ানোর জন্য মোবাইল সংস্থাগুলিরও ‘চাপ’ থাকে। গ্রাহক বাড়লে স্বাভাবিক ভাবেই লাভ বাড়বে টেলিকম সংস্থার। ফলে গুরুত্ব দেওয়া হয় না নজরদারির দিকে।
টেলিকম সংস্থাগুলির সংগঠন ‘সেলুলার অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’র অধিকর্তা রাজন এস ম্যাথুজ অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁরা সরকারি নিয়ম মানতে দায়বদ্ধ। এবং সেই মতো দেশ জুড়ে মাসে গড়ে ৫০ লক্ষেরও বেশি নতুন সংযোগ দেন। টেলিকম দফতর অডিট করার সময় কিছু ক্ষেত্রে আবেদনপত্রে নিয়ম না মানার যে নিদর্শন পেয়েছে, তা তাঁদের জানানো হয়েছে।
তবে কোনও ভাবেই আবেদনপত্রে বেনিয়ম তাঁরা সমর্থন করেন না। তাঁর দাবি, আবেদনপত্র সংক্রান্ত বিষয়টি কী ভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে জন্য তাঁরা নিয়মিত টেলিকম দফতরের সঙ্গে আলোচনা করেন। বেনিয়ম ধরে তা সংশোধনের জন্য তিন মাস অন্তর টেলিকম দফতরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের সঙ্গেও বৈঠকে বসেন তাঁরা। কিছু পদ্ধতিগত সংশোধন ইতিমধ্যেই করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কিছু পদক্ষেপ করার চেষ্টা চলছে।