হেঁসেলের গ্যাস অটোয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার খেয়াদায়। —নিজস্ব চিত্র
তেলের বদলে গ্যাস এসেছে। আর কাটা-তেলের বদলে এসে গিয়েছে কাটা-গ্যাস। অভিনব কায়দায় রান্নার গ্যাস হেঁসেলের বদলে ঢুকে যাচ্ছে অটোয়।
কেমন সেই কায়দা?
বানতলা থেকে বাসন্তী হাইওয়ে দিয়ে সোনারপুর যাওয়ার পথে ডান দিকে বাঁক নিয়ে ঢুকতে হবে খেয়াদার দিকে। কিছু দূর এগিয়ে একটি ঢালু রাস্তা ধরে নেমে অটোয় মিনিট পাঁচেকের মোরাম-পথ। অটো গিয়ে থামল টিনের চালের এক চিলতে একটা বাড়ির সামনে। এটাই ‘কাটা-গ্যাস’-এর দোকান। সার দিয়ে তিন-চারটি অটো দাঁড়ানো। দোকানের সামনে গ্রিলের দরজা। পেরোলেই ফাঁকা জায়গা। সেখানে এক কোণে একটি গ্যাসের সিলিন্ডার। মাঝখানে কম্প্রেসার। সেখান থেকে দু’দিকে দু’টি পাইপ বেরিয়েছে। একটি গিয়েছে গ্যাস সিলিন্ডারে, অন্যটি অটোতে। লম্বা লোহার রড দিয়ে এক জন চাপ দিচ্ছে কম্প্রেসারে। সেই চাপে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস যাচ্ছে অটোতে। চালক অটো ঝাঁকিয়ে দেখে নিচ্ছেন গ্যাস ঠিক মতো ট্যাঙ্কে ঢুকছে কি না। মিনিট পাঁচেকেই অটোয় গ্যাস ভরা শেষ। টাকা মিটিয়ে অটো রওনা দিল যাত্রী তুলতে।
এ ভাবেই দিনের পর দিন পাম্প থেকে গ্যাস নেওয়ার বদলে বেআইনি ভাবে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে চোরাপথে গ্যাস চলে যাচ্ছে অটোয়। পেট্রোলে চলা অটোর ক্ষেত্রে যে ভাবে রমরমিয়ে চলে ‘কাটা-তেল’-এর ব্যবসা, অনেকটা সে ভাবেই।
অটো চালকদের বক্তব্য, এ সব যে চলে, তা জানেন প্রশাসনের সব মহলের কর্তারাই। শাসক দলের অটো ইউনিয়নের এক নেতার কথায়, ‘‘ঠিক সময় নজরানা পৌঁছে যায় কর্তাদের কাছে। তারই সুবাদে তাঁরা চোখ বন্ধ রাখেন।’’
কিছু দিন আগে বজবজের ঘটনার কথাই ধরা যাক। মাস কয়েক আগে সেখানে পুলিশ ধরপাকড় শুরু করায় কিছু দিন বন্ধ ছিল কাটা-গ্যাসের দোকান। কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পরে ফের রমরমিয়ে চলছে ব্যবসা।
শুধু কি খেয়াদা বা বজবজ! কলকাতার চারপাশে ক্রমশ বাড়ছে কাটা-গ্যাস বিক্রির চক্র। লিলুয়া, উত্তরপাড়া, কোন্নগর থেকে শুরু করে উত্তর কলকাতার সীমান্তে লেকটাউন, মধ্যমগ্রাম, কিংবা দক্ষিণের মুকুন্দপুর-দাসপাড়া, নয়াবাদ, বানতলা, তপসিয়া, হরিদেবপুর, কবরডাঙা, মহেশতলা, চৌহাটি, হরিনাভি, কামালগাজি বাইপাস, সোনারপুর স্টেশন রোড, পাঁচপোতা— সর্বত্র এখন কাটা-গ্যাসের রমরমা।
কিন্তু অটো চালকেরা কেন পাম্প-এর গ্যাসের চেয়ে কাটা-গ্যাসই বেশি পছন্দ করেন?
শাসক দলের ওই নেতা বলেন, ‘‘রান্নার গ্যাস বেশি ঘন। অটোর গ্যাস সেই তুলনায় পাতলা। অটোর গ্যাস লিটার-প্রতি দাম ৪০ টাকা এবং রান্নার গ্যাস লিটার-প্রতি ৫৩ টাকা। কিন্তু রান্নার গ্যাস ঘন হওয়ায় এক লিটারে অনেক বেশি কিলোমিটার চলে অটো।’’ অটো চালকদের হিসেবে, পাম্পের গ্যাসে যেখানে প্রতি লিটারে গড়ে ১৮ কিলোমিটার চলে, সেখানে কাটা-গ্যাসে ২৬ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়।
যদিও অটো চালকদের কাটা-গ্যাসে পৌষমাস হলেও সার্বিক ভাবে রান্নার গ্যাস ব্যবহারে ক্ষতির বহরই বেশি। কী সেই ক্ষতি?
পরিবহণ দফতরের কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, রান্নার গ্যাসে গাড়ি চালালে দূষণ ছড়ায় বেশি। গাড়ির গ্যাস অনেক পাতলা হওয়ায় দূষণের মাত্রা কম। পাশাপাশি, পাম্প থেকে দেওয়া গ্যাসে সরকার ভর্তুকি দেয় না। কিন্তু রান্নার গ্যাসে সরকার ভর্তুকি দেয়। ফলে কাটা-গ্যাসের সমান্তরাল বাজার চললে রাজস্ব ক্ষতি হয় সরকারের।
পশ্চিমবঙ্গ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা তুষার সেন বলেন, ‘‘সরকার যদি এই ব্যবসা বন্ধ করতে চাইত, তাহলে এমন ঘটনা দীর্ঘকাল ধরে চলতে পারে না। আমরা বার বার সরকারকে জানিয়েছি। স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি।’’ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের দাবি, ‘‘এক সময় কাটা-তেল দূষণ ছ়ড়াত, তখনও সরকার কিছু করেনি। এখন এসেছে কাটা-গ্যাস। এখনও সরকারের কোনও হেলদোল নেই!’’