কর্পোরেট রেওয়াজে জৌলুস ফিরে পাচ্ছে রাজ্য পর্যটন

এক দিকে নিজের ঘর সামলানোর দায়। দেওয়ালের যাবতীয় ফুটো-ফাটা বুজিয়ে নিশ্ছিদ্র করে তুলতে হবে। একই সঙ্গে ঝাঁপাতে হবে বাড়তি জমি দখলের জন্য।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৬ ০৪:২৩
Share:

এক দিকে নিজের ঘর সামলানোর দায়। দেওয়ালের যাবতীয় ফুটো-ফাটা বুজিয়ে নিশ্ছিদ্র করে তুলতে হবে। একই সঙ্গে ঝাঁপাতে হবে বাড়তি জমি দখলের জন্য।

Advertisement

তবেই না টক্করের বাজারে টিকে থাকা যাবে!

কর্পোরেটের এই মন্ত্রেই ব্যতিক্রমী পথে চলছে রাজ্য সরকারের সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগম। গত এক বছর ধরে। অনিয়ম ও চুরি ধরার পাশাপাশি বাজে খরচে রাশ পড়েছে। তেজের ছোঁয়া বিপণনে। চলছে বড় বড় ব্যবসায়ী সংস্থায় গিয়ে কথা বলা। নিজেদের তুলে ধরা। খবরের কাগজ, এফএম রেডিও-য় আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনও চোখ টানছে।

Advertisement

সব মিলিয়ে যাকে বলে ‘অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং।’ এমনকী, ব্যবসা টানতে নিজস্ব ওয়েবসাইটের চেহারা আমূল বদলে ফেলছে নিগম। নেওয়া হয়েছে আরও কিছু ‘যুগান্তকারী’ সিদ্ধান্ত। কী রকম?

যেমন, দাঁড়ি পড়েছে কর্তাদের বিলাস-সফরে। এত দিন বড় কোনও কর্তা সপার্ষদ ট্যুরিস্ট লজ পরিদর্শনে গেলে আপ্যায়নের রাজকীয় আয়োজন বাঁধা ছিল। তাঁরা খান বা না খান, ইয়া বড় বড় চিংড়ি, চিকেন-মাটনের জাঁকালো নানা পদ হাজির করা হতো টেবিলে। পরে কলকাতার সদরে হিসেব যেত— অমুক অফিসারের ‘ইন্সপেকশন’ বাবদ বাজার-খরচ দশ হাজার টাকা। সত্যিই অত লেগেছে কি না, কেউ হিসেব নিত না। এখন দিন বদলেছে। নিগমের এমডি-ও সরকারি কাজে গেলে তাঁর জন্য লজের সে দিনের মেনুই বরাদ্দ। খাবারের বিলে তাঁকে সইও করতে হচ্ছে।

ব্যয়সঙ্কোচের আরও দৃষ্টান্ত মজুত। নিগমের তিনটি বিলাসবহুল জলযান রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ একটি কোম্পানি বছরে ৭৫ লক্ষ টাকা বিল ধরাচ্ছিল। ক’দিন আগে টেন্ডার ডেকে বরাত হাতবদল হয়েছে। খরচ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ লক্ষে।

আর এ সবের দৌলতে দ্বিগুণ হয়েছে মুনাফার বহর। লজ চালিয়ে, বাস-লঞ্চে ট্যুরিস্ট ঘুরিয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে নিগম লাভ করেছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে যা ছিল মেরেকেটে দু’কোটি, ২০১৩-১৪য় এক কোটির সামান্য বেশি। ট্যুরিস্ট লজে বিলিতি মদের দোকানের বিক্রি কিংবা ইনসেনটিভ স্কিম ও সুদ বাবদ আয়ের অঙ্কটা হিসেবের বাইরে।

অর্থাৎ, বেশ উৎসাহব্যঞ্জক ছবি। রাজ্যের পরিবহণ নিগমগুলি যেখানে দেনার ভারে ন্যুব্জ, তাদের পিছনে ফি বছর পাঁচশো কোটির ভর্তুকি ঢালতে হচ্ছে, সেখানে সরকারি সংস্থা হয়েও পর্যটন কেন ব্যতিক্রমী?

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাই সাফল্যের চাবিকাঠি। বস্তুত পর্যটন নিগম এমনিতে স্বনির্ভর। ৩৩০ জন স্থায়ী কর্মী-সহ ৬১৫ জনের বার্ষিক বেতনের প্রায় এক কোটি টাকা নিজেরাই জোগায়। এ বার পেশাদারিত্বের সঞ্জীবনী দিয়ে তাকে আরও চাঙ্গা করার চেষ্টা চলছে। যে কারণে জলযান দেখভালের দায়িত্ব বর্তেছে অবসরপ্রাপ্ত এক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের উপরে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্টের এক প্রাক্তন অধ্যক্ষ ইতিমধ্যে ২৯টি লজের হেঁসেল ঘুরে নানা খামতি চিহ্নিত করে গিয়েছেন, দাওয়াইও বাতলেছেন। আপাতত স্থির হয়েছে, লজের ম্যানেজার পদে হোটেল ম্যানেজমেন্ট স্নাতকদের বসানো হবে।

উপরন্তু দেখা হচ্ছে, লজে যাতে আরও বেশি পর্যটক আসেন। তাই সদরের অনুমতি ছাড়া ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ম্যানেজারদের হাতে, আগে যা ছিল পাঁচ হাজার। সুবিধা হচ্ছে বিস্তর। উপরওয়ালার সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষায় না-থেকে চটজলদি ছোটখাটো মেরামতি বা সংস্কার যাচ্ছে। আখেরে লজের আকর্ষণ বাড়ছে।

তথ্যেও এর প্রতিফলন। নিগমের ২৯টি লজে অতিথি থাকার অনুপাত (অকুপ্যান্সি রেশিও) ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে ছিল ৪১.৩৪%। ২০১৫-১৬য় হয়েছে ৪৩.২৫%। ‘‘রেশিও বছরে ১% বাড়লেই আয় বাড়ে ৬০ লক্ষ টাকা। নিট মুনাফা এর ২০%। মানে, ১২ লক্ষ টাকা।’’— বলছেন পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা চাই, বেশি লোক বেশি দিন লজে থাকুন। ভাড়া মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে রাখলে সেটা সম্ভব।’’

অনেকটা সম্ভব হচ্ছে ঠিকই। তবে এখানেই শেষ নয়। কর্তারা চাইছেন, পর্যটক কখন আসবে, সে দিকে তাকিয়ে না-থেকে নিগমই আগেভাগে পর্যটক ধরতে বেরোক। আগ্রাসী বিপণনের এই তাগিদেই অপচয়-অনিয়ম রোধের সঙ্গে নিজেদের তুলে ধরার নানাবিধ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে পর্যটন উন্নয়ন নিগম।

বুঝিয়ে দিচ্ছে, ইচ্ছে থাকলে উপায়ও হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন