Cyclone Amphan

ভেজা চাল রোদে শুকিয়ে বাঁচার লড়াই

সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা তো বটেই, গতিপথ বদলে আমপান ক্ষতবিক্ষত করে গিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ, বাগদা, গোবরডাঙা, হাবড়ার মতো এলাকাগুলিকেও।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২০ ০৩:৪১
Share:

রেশনে পাওয়া চাল রোদে শুকোতে দেওয়া হয়েছে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

জলে ধুয়ে গিয়েছে আটা। রেশনে পাওয়া চাল ভিজে একসা। পচতেও শুরু করেছে। সেই চালই প্লাস্টিকের বস্তার উপরে ছড়িয়ে শুকোতে দিয়েছেন কাকলি হালদার। বললেন, ‘‘চাল পচা না ভাল এখন ভেবে লাভ নেই। ফুটিয়ে খেলে পেটটা ভরবে। সরকারি ত্রাণ তো কিছুই পেলাম না।’’

Advertisement

সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা তো বটেই, গতিপথ বদলে আমপান ক্ষতবিক্ষত করে গিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ, বাগদা, গোবরডাঙা, হাবড়ার মতো এলাকাগুলিকেও। গাছ উল্টে, বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে, বাড়ির চাল উড়ে সেই ক্ষতচিহ্ন এখনও দগদগে বহু এলাকায়। কেউ খোলা আকাশের নীচে, কেউ এক টুকরো প্লাস্টিক জুটিয়ে, কেউ পড়শির বাড়িতে রাত কাটাচ্ছেন। চেয়েচিন্তে খাওয়া জুটছে এক-আধবেলা। একে তো লকডাউনে ভাঁড়ে মা ভবানী ভর করেইছিলেন। ছা-পোষা মানুষগুলো আমপানের ছোবল সামলে কী ভাবে ফের দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে বাঁচবেন, তার কোনও দিশা পাচ্ছেন না কোনও দিক থেকে।

রবিবার বাগদার ধুলোনি গ্রামে গিয়ে দেখা হল কাকলির সঙ্গে। আমপানের তোড়ে চোখের সামনে উড়ে যেতে দেখেছেন বাড়ির চাল-চুলো। আপাতত মাটির বাড়ির ভিতটুকু শুধু বেঁচে আছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তোষক-বালিশ, খাট, কাঠের বাক্স, ছেলেমেয়েদের বইখাতা। খানিক দূরে পড়ে বাড়ির টিনের চালের কাঠামো।

Advertisement

আরও পড়ুন: মৃত্যু ঠেকিয়েও ধাক্কা কেন পরিকাঠামোয়

কাকলির কথায়, ‘‘ঝড়ের সময়ে দুই ছেলেমেয়ে, স্বামীকে নিয়ে ঘরেই ছিলাম। সন্ধে ৭টা বাজে তখন। মনে হচ্ছিল, পুরো আকাশটাই যেন ভেঙে পড়বে মাথায়। প্রকৃতির এমন তাণ্ডবে প্রাণ বাঁচবে বলে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। রাত ১১টার পড়ে আর শেষরক্ষা হল না। ঘরের চাল, কাঠামো ভেঙে উড়ে গেল চোখের সামনে। ভাগ্যিস কেউ আমরা চোট পাইনি। কিন্তু এ বার কী ভাবে বাঁচব, কী ভাবে ফের ঘর বাঁধব— কিছুই জানি না।’’ কথা বলতে বলতে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না সদ্য ঘরহারা ঘরণী।

আপাতত পড়শিদের বাড়িতে ঠাঁই হয়েছে সপরিবার। কাকলি জানালেন, সরকারি সাহায্যের একটা ত্রিপলও পাননি। পাকা ঘরের আবেদন আগেই করেছিলেন। কিন্তু মেলেনি। তরুণীর কথায়, ‘‘আমাদের এই তো আর্থিক অবস্থা। কারা কোন নিয়মে ঘর পায় বা পায় না— তা তো আজও বুঝলাম না!’’

আরও পড়ুন: ঝড়ে বিকল সিগন্যাল, নিয়ম ভেঙে ছুটছে গাড়ি দীক্ষা ভুঁইয়া

ঝামা ইটের এবড়ো খেবড়ো পথে বাইক নিয়ে যেতে যেতে দেখা গেল, বিশাল বিশাল গাছগুলো শিকড়-সুদ্ধ উপড়ে গিয়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি ধরে মুচড়ে দিয়েছে হাওয়ার বেগ। কোনও কোনও গাছের পাতা ঝরে কঙ্কালের মতো চেহারায় দাঁড়িয়ে। চারি দিকে শুকনো নিরন্ন মুখের সারি।

কাদারডাঙায় রামানন্দন হালদার, নমিতা হালদারদের বাড়ির টিনের চাল উড়ে গিয়েছে। সে সব কুড়িয়ে এনে ভাঙা জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ত্রাণ পাননি কেউ।

জলে ডোবা ধান খেত থেকে ফসল কেটে নিচ্ছিলেন বিষ্টুপদ সর্দার। নিজের এবং ভাগে নিয়ে দেড় বিঘে জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। গোটা খেতটাই আপাতত জলের তলায়। হাজার পনেরো টাকা লেগেছিল চাষ করতে। এখন শ্রমিকের টাকাও গুণতে হচ্ছে। পাশ দিয়ে সাঁতার কেটে চলে গেল শাঁখামুটে সাপ।

শব্দ করে কাঁদতে পারছেন না প্রৌঢ়। কথা বলতে বলতে বার বার চোখ মুছছিলেন। বললেন, ‘‘এ ধান জমিতে রেখে দিলে পচে যাবে। কোথাও যে বিক্রি করব, এখন সে অবস্থা নেই। বাড়িতেই রেখে দিই। অন্তত নিজেদের ভাতটুকু জুটে যাবে। ধারের টাকা শোধ করব কী ভাবে, জানি না।’’ ধুলোনি পেরিয়ে রানিহাটি ঘাটপাতিলা পূর্বহুদা গ্রামে পৌঁছে দেখা গেল, সজল ধারা প্রকল্পে জেনারেটর চালিয়ে পানীয় জল তোলা হচ্ছে। আগে ২০ লিটার জল মিলত ৫ টাকায়। এখন কিনতে হচ্ছে ১০ টাকায়। এখানকার বহু বাসিন্দা ভিন্ রাজ্যে কাজে গিয়েছিলেন। প্রায় কেউই ফিরতে পারেননি লকডাউনে। মহিলাদের ভিড় বেশি গ্রামে।

মুখে মাস্ক ছাড়াই তিন মহিলা যাচ্ছিলেন জল কিনতে। মাস্ক পরেননি কেন? প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে তাকালেন। একজনের কাছ থেকে উত্তর এল, ‘‘এমনিতে তো মরেই আছি। করোনা আর কী মারবে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন