ঘরটা ভেসে যায়নি, স্বস্তি ঝড় শেষে

দুপুরের কাঠফাটা রোদে ভাঙা মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসেও এমনই চিন্তায় বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ়।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

ফ্রেজারগঞ্জ শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৯ ০৩:৪২
Share:

হাতিকর্ণার গ্রামে ভাঙা বাড়ির দাওয়াই বসে দেবব্রত দাস। নিজস্ব চিত্র

সকাল থেকে হন্যে হয়ে খুঁজে ‘দু’টো’-কে পেয়েছেন। কিন্তু ‘আর দুটো, কোথায় গেল?’

Advertisement

দুপুরের কাঠফাটা রোদে ভাঙা মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসেও এমনই চিন্তায় বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ়। ফণী আছড়ে পড়ার আশঙ্কা কাটতে শনিবার দুপুরেই বেমালুম পাল্টে গিয়েছে আবহাওয়া। ফ্রেজারগঞ্জের হাতিকর্ণার গ্রামের দেবব্রত দাস তাঁর গরুদের খুঁজে চলেছেন।

ফণীর আশঙ্কায় তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন নিজের চারটি গরুকে। ‘‘নিজেরা বাঁচবো কি না জানতাম না। তাই অবলা জীবগুলিকে শুক্রবার সকালেই গোয়াল থেকে বের করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যদি প্রাণে বাঁচে, তাহলে ফের খুঁজে নেব।’’— বলছিলেন দেবব্রত। শনিবার সকাল হতেই ফের খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছেন। ‘গরু খোঁজা’ খুঁজে পাশের গ্রামের মাঠ থেকে দু’টিকে পেলেও, নিরুদ্দেশ বাকি দু’টি।

Advertisement

শুক্রবার সকালের ভরা কোটালের সময় থেকেই গ্রামের গা ঘেঁষে থাকা সাগরের জলস্তর বেড়েছে। সমুদ্রকে ঠেকনা দেওয়া কংক্রিটের বাঁধের পাশে থাকা মাটির বাঁধ উপচে নোনা জল ঢুকেছিল দেবব্রতবাবুদের গ্রামে। মাটির ঘরে ঢুকেছিল জল। বিপদের আশঙ্কায় স্থানীয় প্রশাসন সকালেই খালি করে দিয়েছিল হাতিকর্ণার গ্রাম। মাটির বাড়ি ছেড়ে স্থানীয় হোটেল, স্কুলে আশ্রয় নিতে যাওয়ার আগে তাই দেবব্রতর মতো গবাদি পশু, মুরগিদের ছেড়ে দিয়েছিলেন মীন ধরে পেট চালানো সীতারানি সর্দারেরা। সকালের পরে রাতে ফের ভরা কোটালের জল গ্রাস করেছে ওই গ্রাম। কেমন আছে ভিটে মাটি? জানতে মন আনচান করলেও রাতের অন্ধকারে বাঁধ ধরে হেঁটে গ্রামে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ-প্রশাসন। আর তাই দূরে আশ্রয়স্থলে বসে শুধু জল ঢোকার হু-হু শব্দ শুনেছেন গ্রামবাসী।

তবে ফণী আতঙ্ক কাটিয়ে শনিবার সকাল হতেই তাঁরা সকলেই ফিরে এসেছেন নিজের ঘরে। ভাটার টানে সাগর তখন অনেকটা দূরে। ঘরে থাকা ভেজা চাল ধামায় করে রোদে শুকিয়ে নিয়ে কোনও মতে ফুটিয়ে নিয়েছেন সীতারাণীর মতো অনেকেই। সকলেই বলছেন ‘‘নিজের ঘরের থেকে শান্তি আর কোথাও নেই গো বাবু।’’ যদিও ভরা কোটালে হাতিকর্ণার গ্রামের দেবব্রতর মতো আরও কয়েক জনের মাটির বাড়ি ধুয়ে গিয়েছে সাগরের জলে।

বাড়ি ভেঙে যাওয়া চিন্তার। কিন্তু দশ বছর আগের আয়লার ঘা আরও বেশি যন্ত্রণা দেয় ফ্রেজারগঞ্জের হরিপুর, দেবনিবাস, লক্ষ্মীপুর, শিবপুর গ্রামের বাসিন্দাদের। ‘‘এখন যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, আয়লার সময় এখানে এক কোমর জল ছিল, কত মানুষ, পশু খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল’’— নামখানার ১০ মাইল এলাকার সাইক্লোন সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে স্মৃতি উস্কাচ্ছিলেন দেবনিবাস গ্রামের বাসিন্দা শিখা হাজরা। শুক্রবার সকালেই গাঁয়ের সকলের সঙ্গে তিনিও দলিল, জমানো টাকা পুঁটলিতে বেঁধে নিয়ে চলে এসেছিলেন ওই আশ্রয়স্থলে। একতলায় গবাদি পশু আর উপরের দুটি তলায় ঠাঁই মিলেছিল গ্রামবাসীদের।

রাতে দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি নামতেই দশ বছর আগের আতঙ্ক ফের গ্রাস করেছিল সাইক্লোন সেন্টারে জড়ো হওয়া মানুষদের। কিন্তু শনিবার সকালের কড়া রোদে উবে গিয়েছে সমস্ত সংশয়। সকাল হতেই হাসিমুখে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছেন শিখাদেবী, ভারতী হাজরারা। বললেন, "আয়লার পরে তো বাড়িটা দেখতে পাইনি। এ বার সেটা হয়নি ।"

নামখানা থেকে বকখালি যাওয়ার রাজ্য সড়কে ধূ-ধূ রাস্তার পাশে কয়েকটা কলা গাছ নুয়ে পড়েছে। যা দেখিয়ে বৃদ্ধ চায়ের দোকানির মন্তব্য ‘‘রাখে হরি মারে কে।’’ ফণীর ছোবলে উড়েছে নামখানা স্টেশনের বেশ কয়েকটি টিনের শেড। ভেঙেছে ফ্রেজারগঞ্জের বেশ কয়েক অঙ্গণওয়াড়িকেন্দ্র।

হাতিকর্নারে সাগর ঘেঁষা বাঁধের পাশে মাটির দাওয়ায় বসে দেবব্রত তবু বলে চলেন, ‘‘সাগরের গন্ধ আমরা বুঝি। ও কখনও নেয়, আবার কখনও ফিরিয়েও দেয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন