খ্যাতির নেশায় খামতির পাহাড়

বাই তো উঠল। কিন্তু তার পর? কতটা প্রস্তুতি পেরোলে তবে ৮৮৪৮ মিটার উচ্চতার শৃঙ্গ অভিযানে পা বাড়ানো যায়? সেই প্রস্তুতির অভাবেই কি বারবার বিপদের মুখে পড়তে হচ্ছে অভিযাত্রীদের? অভিজ্ঞ আরোহীদের বড় অংশের মত কিন্তু সেটাই।

Advertisement

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৬ ০৪:০০
Share:

উঠল বাই তো এভারেস্ট যাই।

Advertisement

বাই তো উঠল। কিন্তু তার পর? কতটা প্রস্তুতি পেরোলে তবে ৮৮৪৮ মিটার উচ্চতার শৃঙ্গ অভিযানে পা বাড়ানো যায়? সেই প্রস্তুতির অভাবেই কি বারবার বিপদের মুখে পড়তে হচ্ছে অভিযাত্রীদের? অভিজ্ঞ আরোহীদের বড় অংশের মত কিন্তু সেটাই।

১৯৬৩ সালে যেখানে এভারেস্টে পা রেখেছিলেন ছ’জন, ২০১২ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০-তে। পর্বতারোহীদের অনেকেই বলছেন, এভারেস্টে ওঠাটা ক্রমশ যেন একটা মোহে পরিণত হচ্ছে। অনেকেই যেনতেন প্রকারেণ টাকা জোগাড় করে বেরিয়ে পড়ছেন। কিন্তু ফাঁক থেকে যাচ্ছে অনুশীলনে। অনেকে বুঝতেই চাইছেন না, আদৌ ওই দুর্গম পথে পা বাড়ানোর ক্ষমতা তাঁর আছে কি না।

Advertisement

২০১০ সালে বসন্ত সিংহরায় ও দেবাশিস বিশ্বাস প্রথম অসামরিক বাঙালি হিসেবে ছুঁয়ে ফেলেন এভারেস্ট। ২০১১ সালে ফের সাফল্য পান দীপঙ্কর ঘোষ, রাজীব ভট্টাচার্য। ২০১৩ সালে প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে এভারেস্ট ছুঁয়ে তাক লাগিয়ে দেন ছন্দা গায়েন ও টুসি দাস। ছিলেন উজ্জ্বল রায় এবং দেবদাস নন্দীও। ২০১৪ সালে চিনের দিক থেকে (নর্থ কল) সাফল্য পেলেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায় ও বিপ্লব বৈদ্য। এই ধারাবাহিক সাফল্যেই কি ভুল বার্তা গেল আরোহী মহলে? এভারেস্ট অভিযান কি ‘বাতিক’ হয়ে গেল?

কিছু দিন আগে পর্যন্তও নেপালের পর্বতারোহণ আয়োজক সংস্থাগুলি এভারেস্ট অভিযানের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা শর্ত রাখত, অন্তত পক্ষে একটি সাত-হাজার মিটার শৃঙ্গ ছোঁয়ার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সেই শর্ত উঠে গিয়েছে সম্প্রতি। নেই কোনও বয়সের মাপকাঠি। ফলে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ছাড়াই আট হাজার মিটারে, বিশেষ করে এভারেস্টে পা বাড়াচ্ছেন অভিযাত্রীরা। তেরো বছর থেকে শুরু করে আশি বছর পর্যন্ত। ভারতের যে কোনও শৃঙ্গ আরোহণ করতে গেলে নিতে হয় ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশন (আইএমএফ)-এর অনুমতি। আরোহীদের অভিজ্ঞতা দেখে তবে মেলে অনুমতি।

নেপাল সরকারের এ রকম কোনও নিয়মও নেই। অভিযান আয়োজক সংস্থাগুলি, সব রকমের পরিকাঠামো বানিয়ে রেখেছে এভারেস্টে। কোন পথে হবে অভিযান, কোথায় পড়বে তাঁবু, কোন ঢালে কতটা দড়ি লাগানোর প্রয়োজন, সবটাই পূর্বনির্ধারিত।
অর্থের বিনিময়ে আয়োজিত অভিযান। চাই শুধু টাকা আর আরোহীর যথেষ্ট মানসিক ও শারীরিক জোর। তথ্য বলছে, এ বছরই এভারেস্ট অভিযানের অনুমোদন পেয়েছেন ৬৫০ জন।
তেনজিং নোরগের ছেলে জামলিং নোরগে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট প্রশিক্ষক। বললেন, ‘‘এত অভিযাত্রীর ভিড় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ায় এভারেস্টে। হিলারি স্টেপের কাছে আরোহীদের যে ট্র্যাফিক জ্যাম হয়, তাতেই বিপদে পড়েন অনেকে। বাড়ে ক্লান্তি, ফুরোয় অক্সিজেন।’’

হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসুর গলাতেও চাপা রইল না আক্ষেপ। তাঁর মতে এভারেস্ট এখন একটা মোহ, একটা লোভ। এভারেস্টের তকমা না থাকলে যেন পর্বতারোহী হিসেবে জাতে ওঠা যায় না। এর জন্য সংবাদমাধ্যমকেও খানিকটা দায়ী করছেন অনিমেষবাবু। বললেন, ‘‘এক জন এভারেস্ট আরোহী যতটা প্রচার পান, ততটা মোটেই পান না অন্য কোনও শৃঙ্গ আরোহী। সেই শৃঙ্গ হয়তো এভারেস্টের থেকেও বেশি বিপদসঙ্কুল, হয়তো সেই শৃঙ্গের

পেছনে তাঁর অনেকটা অধ্যবসায় রয়েছে, পরিশ্রম রয়েছে।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এভারেস্টজয়ী তো স্পষ্ট বলেই দিলেন, ‘‘আরোহী মহলে কল্কে পাওয়ার জন্যই এভারেস্ট আরোহণ করতে গিয়েছিলাম।’’ তাঁর দাবি, তিনি অনেক বছর ধরে একাধিক নতুন, নাম না-জানা শৃঙ্গ ছুঁয়েছেন। কিন্তু এক জন সফল পর্বতারোহী হিসেবে পরিচিত হয়েছেন এভারেস্ট চড়ার পরেই।

অনিমেষবাবু তুলে ধরলেন আর একটি দিকও। জানালেন, পর্বতারোহণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ যত অর্থ খরচ করে, ভারতের অন্য কোনও রাজ্যে তা হয় না। কিন্তু, এই খরচ অনেকটাই এভারেস্ট-কেন্দ্রিক। যথাযথ ‘ক্রাইটেরিয়া’-র বাধা না টপকেই মিলে যাচ্ছে সরকারি অনুদান। স্কুল লেভেল থেকে যে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দরকার, সে দিকেও একটু দৃষ্টি দেওয়া উচিত। অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা না মেপেই যে কোনও অভিযাত্রীকে অনুদান দিয়ে দেওয়ার অর্থ, তাঁকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া।

যুবকল্যাণ দফতরের পর্বতারোহণ শাখার উপদেষ্টা উজ্জ্বল রায় অবশ্য বললেন, যোগ্যতার মাপকাঠি ঠিক করা আছে। পর্বতারোহণের বেসিক ও অ্যাডভান্স ট্রেনিং ছাড়াও, অন্তত চারটি ছ’হাজার মিটার উচ্চতার শৃঙ্গ আরোহণের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে আবেদনকারীর। তা কি যথেষ্ট নয়? অভিজ্ঞ আরোহীরা বলছেন, এভারেস্ট কেন, যে কোনও আট-হাজারি শৃঙ্গ অভিযানের আগেই এক বা একাধিক সাত হাজার শৃঙ্গ ছুঁয়ে দেখা খুব জরুরি। প্রথমত, উচ্চতার সঙ্গে আরোহীর শরীর খাপ খাইয়ে নিতে পারছে কি না, তার একটা পরীক্ষা হয়ে যায় এই অভিযানগুলিতে। সেই সঙ্গে বাড়ে অভিজ্ঞতা। বাড়ে বিপদের মুখে নিজেকে বাঁচাতে পারার দক্ষতা।

বাংলার প্রথম অসামরিক এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী বসন্ত সিংহরায়ের কথায়, ‘‘আট হাজার হোক বা পাঁচ হাজার, অভিযান শুরুর আগে পড়াশোনা করতেই হবে। জানতে হবে পথ, রাখতে হবে আবহাওয়ার খবর। মেপে রাখতেই হবে, কী কী ভাবে আসতে পারে বিপদ। সেই সঙ্গে আরোহীর নিজেকে তৈরি করতে হবে, সব রকম বিপদের জন্য তিনি প্রস্তুত কি না।’’

এমনিতেই পর্বতারোহণের মতো একটি ‘এক্সট্রিম স্পোর্টস’-এর ক্ষেত্রে, শারীরিক গঠনের দিক দিয়েই খানিকটা পিছিয়ে থাকেন ভারতীয়রা। এক জন পশ্চিমী অভিযাত্রীর দক্ষতার সঙ্গে তাই তুলনাই হয় না তাঁদের। এভারেস্টের মতো একটা আট হাজারি শৃঙ্গ আরোহণের জন্য যতটা শারীরিক সক্ষমতা প্রয়োজন, তা আয়ত্ত করতে হলে এক জন আরোহীকে যে চূড়ান্ত পরিশ্রম ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, যতটা পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়, ততটা মোটেই করে ওঠা হয় না এক জন মধ্যবিত্ত বাঙালির। অনেকটা স্বপ্ন আর অদম্য মনের
জোর থাকলেও এভারেস্ট অভিযানের জন্য যে বিপুল পরিমাণ টাকা জোগাড় করতে হয়, তাতেও অনুশীলনের দিকে আর মন দেওয়া হয় না ততটা। বাড়ে বিপদের সম্ভাবনা। আক্ষরিক অর্থেই ‘ডেথ জোন’ হয়ে ওঠে সাউথ কল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন