‘মাতৃভূমি’ কার

জীবন একার হয় না, এই অসহিষ্ণুতা ভয়ঙ্কর

কী বলব একে? উগ্র নারীবাদ? নারী মৌলবাদ? নাকি সমাজের সর্বস্তরে ছেয়ে গিয়েছে অসহিষ্ণুতা তারই একটি দৃষ্টান্ত! কোথা থেকে এ বৈরিতা জন্ম নেয়? শিয়ালদহ-রানাঘাট লাইনে মাতৃভূমি স্পেশ্যাল ট্রেনকে কেন্দ্র করে খড়দহ স্টেশনে নারী বনাম পুরুষের যে সাম্প্রতিক খণ্ডযুদ্ধ এ রাজ্য প্রত্যক্ষ করল, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমরা বিচলিত, মর্মাহত।

Advertisement

তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১
Share:

কী বলব একে? উগ্র নারীবাদ? নারী মৌলবাদ? নাকি সমাজের সর্বস্তরে ছেয়ে গিয়েছে অসহিষ্ণুতা তারই একটি দৃষ্টান্ত! কোথা থেকে এ বৈরিতা জন্ম নেয়?

Advertisement

শিয়ালদহ-রানাঘাট লাইনে মাতৃভূমি স্পেশ্যাল ট্রেনকে কেন্দ্র করে খড়দহ স্টেশনে নারী বনাম পুরুষের যে সাম্প্রতিক খণ্ডযুদ্ধ এ রাজ্য প্রত্যক্ষ করল, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমরা বিচলিত, মর্মাহত।

মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নতুন নয়। শতাব্দীপ্রাচীন এই যুদ্ধ চলবে আরও কত কাল, বলা শক্ত। কিন্তু যত দিনই তা চলুক, ঘৃণা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা সেই সংগ্রামের পাথেয় হতে পারে না।

Advertisement

আজ অবধি নারী যত রকমে শোষিত ও বঞ্চিত হয়েছে, তার জন্য একান্ত ভাবে পুরুষকেই দায়ী করার মধ্যে এক রকম একপেশে বুদ্ধি কাজ করে। তার প্রভাব কম নয়। এ এমন এক সময়, যখন যে কোনও প্রকারে কাউকে এক বার শত্রু প্রতিপন্ন করে দিতে পারলে মেরুকরণ যন্ত্র বিভেদ-বুদ্ধি সমেত আপনিই সচল হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ চিন্তার দৈন্য। এই দীনতাই সমাজের বহু গুরুত্বপূর্ণ বৈষম্য জারি রাখতে সহায়ক হয়। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সমাজ-সচেতন প্রগতিবাদী পুরুষের ভূমিকাও নরনারীর দ্বান্দ্বিক অবস্থান দূর করতে পারেনি। শুধু যে অবস্থানগত সংঘাত তাই নয়। নারী ও পুরুষ ক্রমশ প্রতিযোগী হয়ে উঠছে। কাজের জগতে মেয়েরা বেশি আসছেন বলে ছেলেরা সুযোগ কম পাচ্ছেন, এমন অভিযোগ আজকাল প্রায়ই শুনতে পাই। অথচ এখানে মূল সমস্যা সুযোগের অভাব। যোগ্যতার সঙ্কট। অথচ, প্রতিযোগী হয়ে যাচ্ছে প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক।

সে দিনের নারী বনাম পুরুষ খণ্ডযুদ্ধ এমন মানসিকতারও প্রতিফলন। এবং এই অসৌজন্য ও আত্মসর্বস্ব, শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা এই লড়াইকে দীর্ঘায়িতই করবে। মাত্র বুধবারই ঘটে যাওয়া ঘটনা তার সাক্ষী। বামনগাছি এলাকায় কার্যত একটি রটনা নির্ভর করে এ বার কতিপয় পুরুষ উঠে এলেন মহিলাদের কামরায়। আবার একটি খণ্ডযুদ্ধ হল। এর আগের যুদ্ধে পুরুষ মার খেয়েছিল, এ বার মেয়েরা মার খেল। এর শেষ কোথায়? সম্ভাবনা আছে এই ঘটনাগুলিতে রাজনীতি ঢুকে পড়ার। সম্ভাবনা আছে ঘরে ঘরে নারী আর পুরুষের বন্ধুত্ব ভুলে যুযুধান হয়ে ওঠার। না। এমন পরিস্থিতি আমাদের কাম্য নয়।

রেলমন্ত্রী থাকাকালীন শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মেয়েদের জন্য গোটা ট্রেন চালু করলেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করার আগে হয়তো এই সমীক্ষা রেল দফতর করেছিল যে, প্রত্যেক লোকাল ট্রেনে মহিলা-কামরার সংখ্যা বৃদ্ধি করলেই মেয়েদের নিত্যযাত্রা সমস্যা কিছুটা কমে, নাকি গুটিকয় ট্রেন একেবারে আপাদমস্তক মেয়েদের জন্য করে দিলেই সমাধান! অন্তত রাজনৈতিক সাফল্যের হাততালি কুড়োনোর পক্ষে যে মেয়েদের জন্য আস্ত ট্রেনের ফিতে-কাটা মহত্তর উপায়, সেটা বোঝায় ভুল ছিল না। রেলের সমীক্ষা যা-ই বলুক, বাস্তবে দেখা যাচ্ছিল, মাতৃভূমি স্পেশাল অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অলাভজনক। এমনকী, যখন হাজার হাজার পুরুষ যাত্রী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন অথবা সাধারণ ট্রেনে ঝুলতে ঝুলতে চলেছেন— সেখানে লেডিজ স্পেশাল তিরিশ শতাংশ মাত্র আসন ভরে ফাঁকা চলেছে। অর্থাৎ, শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়। উপায় থাকা সত্ত্বেও, বহু যাত্রী, শুধু পুরুষ হওয়ার অপরাধে, বাঞ্ছিত পরিষেবা প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

পরিস্থিতির নিরিখে রেল যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছিল। মাতৃভূমি স্পেশ্যালের ৯টি কামরার ৩টি জেনারেল করা হয়েছিল। পুরুষেরা যার ব্যবহার শুরু করলে বেশ কয়েক জন মহিলা তা অনধিকার চর্চা বলে ধরে নিলেন। তার ফলাফল নিন্দনীয় হল।

কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। শিয়ালদহ শাখায় কোনও স্টেশনে এক তরুণ চলন্ত ট্রেন ধরতে গিয়ে হাতের কাছে মহিলা কামরা পেয়ে উঠে পড়ে। কয়েক জন মহিলা এই অনধিকারীকে চলন্ত ট্রেন থেকে ঠেলে ফেলে দেয়। দিল্লি মেট্রোতেও ঘটেছিল এমন একটি ঘটনা।

শুধু ট্রেনই বা কেন? বাসে, মেট্রো রেলে, মহিলাদের ভিড়ে কোনও পুরুষ ঢুকে পড়লে তাঁর লাঞ্ছনা সীমা ছাড়িয়ে যায়। হতে পারে, ভুক্তভোগী নারীমাত্রই পথেঘাটে বিকৃতকাম পুরুষের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেন। তারই উচ্চকিত প্রকাশ ঘটে পুরুষের নারীব্যূহ ভেদে। এই আচরণ ব্যাখ্যাযোগ্য মানেই কিন্তু সমর্থনীয় নয়। এতে একের দোষে অপরে অভিযুক্ত হয়। এমনকী, অন্যায়কারী পুরুষের মতোই নারীর আচরণ অন্যায় বলে মনে হয় কখনও। দুই-ই শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যায়। কিন্তু লেডিজ স্পেশ্যালে মাত্র তিনটি পৃথক কামরায় পুরুষের উপস্থিতি তার জন্য অবাঞ্ছিত হতে পারে না। তা হলে এত রোষ কীসের? নারীর জন্য আয়োজিত পৃথক পরিষেবা হারানোর ভয়? এখানে শুভবুদ্ধির অভাব লক্ষণীয়। অধিকারের সঙ্গে দায়িত্ববোধ ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। সমাজ যে অধিকার দেয়, তার সঙ্গে সঙ্গেই দায়িত্ব আসে এই বিষয়ে সচেতন হওয়ার, যে, এক জনকে অধিকার দিতে গিয়ে আর এক জনের প্রতি অবিচার হচ্ছে কি না। যে মহিলারা ট্রেন থেকে পুরুষদের টেনে নামিয়েছিলেন, তাঁদের দিকে পাথর ছুড়েছিলেন, তাঁরাই হয়তো ঘরে ফিরে স্বামীর জন্য রান্না করেছেন, ছেলেকে কোলে তুলেছেন, হয়তো পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে হেসে মুড়িমাখা ভাগ করে খেয়েছেন।
তাঁদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে ট্রেন কেন্দ্র করে। কারণ, তাঁরা অধিকারবোধ থেকে দখলদারি মানসিকতায় নেমে এসেছেন।

এঁরা কি পুরুষকে ঘৃণা করেন? হতে পারে, কেউ কেউ করেন। হতে পারে, পরিবারে বা কর্মক্ষেত্রে কোনও অসাম্য বা অমর্যাদাজনিত ক্ষোভ এমন ঘৃণার মধ্যে প্রকাশ পায়। বা, এ হল ‘সুবিধা’ কুক্ষিগত করার সামাজিক ব্যাধি। যা ‘আমি’ ভোগ করব, আর কেউ নয়। যদি ভাগাভাগি একটু অন্য রকম হতো, যদি তার ভিত্তি হতো আর কিছু, নারী-পুরুষ না হয়ে সাদা-কালো নারী বা রোগা-মোটা নারী, তা হলেও এই অসহিষ্ণু, আত্মপর আচরণ প্রকাশ পেতে পারত।

উগ্র নারীবাদ জগতকে নারী বনাম পুরুষ হিসেবে দেখে। উগ্র রাজনীতি নাগরিক সমাজকে আমরা-ওরা করে দেয়। উগ্র সমাজনীতি মানুষকে ভাগ করে বর্ণ দিয়ে, জন্মপরিচয় দিয়ে, ধনী-দরিদ্র দিয়ে, জাতি-বর্ণ দিয়ে। এই অসহিষ্ণুতা ভয়ঙ্কর। আমাদের বুঝতে হবে, জীবন একার নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য একার নয়, ঘৃণা ‌ও বৈষম্যমূলক চিন্তা যে সমাজকে আচ্ছন্ন করে, তা কারও পক্ষেই মঙ্গলময় নয়। শিক্ষা-সচেতনতার ব্যাপক প্রসারই এই ব্যাধি থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন