মেয়েদের হাতে মুক্তির মশাল

নিজের পায়ে দাঁড়াবই, যুদ্ধে কন্যারা

টানা ছ’দিনের নার্সিং প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে খানিক আগে। বৃষ্টির জন্য রঘুনাথগঞ্জ ১ গ্রাম পঞ্চায়েত ভবনেই আটকে পড়েছে বেনজির খাতুন। শ্রীকান্তবাটি হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীটি বলছে, ‘‘জানেন, স্বপ্ন দেখতাম ডাক্তার হব। কিন্তু বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।

Advertisement

বিমান হাজরা

রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৫৬
Share:

মুর্শিদাবাদে নার্সিংয়ের প্রশিক্ষণ। অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

টানা ছ’দিনের নার্সিং প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে খানিক আগে। বৃষ্টির জন্য রঘুনাথগঞ্জ ১ গ্রাম পঞ্চায়েত ভবনেই আটকে পড়েছে বেনজির খাতুন। শ্রীকান্তবাটি হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীটি বলছে, ‘‘জানেন, স্বপ্ন দেখতাম ডাক্তার হব। কিন্তু বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তিই হতে পারিনি।’’ নার্সিং প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর মনে হচ্ছে, ‘‘ডাক্তার হতে পারিনি তো কী, নার্সিংকে তো জীবিকা হিসেবে বেছে নিতেই পারি।’’

Advertisement

নতুন কিছু করার স্বপ্নে টগবগ করছে বেনজির। বহরমপুরের অন্বেষা বিশ্বাস আবার বিপর্যয় মোকাবিলার দলে যোগ দিতে চায়। বেলডাঙার পারভিন সুলতানা চাইছে, ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে কাজ করতে। মুর্শিদাবাদের এই ‘কন্যাশ্রী’রা সমস্বরে বলছে, ‘‘আগে নিজের পায়ে দাঁড়াই। তার পর অন্য কিছু ভাবব।’’

কন্যাশ্রীতে অষ্টম শ্রেণি থেকে বছরে পাঁচশো টাকা, বয়স ১৮ পেরোলে একলপ্তে ২৫ হাজার টাকা দেয় সরকার। জেলা প্রশাসনের সমীক্ষা বলছে— কন্যাশ্রীর থোক টাকাটা অধিকাংশ অভিভাবকই খরচ করেন মেয়ের বিয়ের পিঁড়িতে! অনেকে অকপটে বলেও ফেলেন, ‘‘ও টাকা তো বিয়ের জন্যই দিচ্ছে সরকার!’’ গাঁ-গঞ্জে এটাই বেশির ভাগ কন্যাশ্রীর পরিণতি! সেখানে মেয়ের ইচ্ছে-অনিচ্ছের দাম নেই। অন্য রকম স্বপ্ন দেখার সুযোগ নেই।

Advertisement

সেই ছবিটা বদলাতেই শুরু হয়েছে ‘কন্যাশ্রী যোদ্ধা’। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন ৯টি ব্লক থেকে ৩০ জন করে কন্যাশ্রীকে বেছে নিয়ে শুরু করেছে বিশেষ পেশাদারি প্রশিক্ষণ। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হাতেকলমে শেখানো হচ্ছে হোম নার্সিং,
স্কাউট কিংবা ক্রেতা সুরক্ষার নিয়মকানুনও। প্রশিক্ষণেরই দায়িত্ব নিয়েছে জেলার বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তেমনই একটি সংস্থার জেলা কো-অর্ডিনেটর জয়ন্ত চৌধুরী বলছেন, “এই মেয়েদের অনেকেই তাক লাগিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছিল না এত দিন।” ধীরে ধীরে সব কন্যাশ্রীকেই প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে বলে জানাচ্ছেন তিনি।

জেলা প্রশাসনের দাবি, এত দিন কন্যাশ্রী মানে যাঁরা বুঝতেন এটা আসলে বরপণের টাকা, সেই ভুল ধারণাটা এ বার ভেঙে যাবে। সরকার মনে করছে, শুধু পড়়াশোনা শেখানোটাই সব নয়, যদি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর রাস্তাটা দেখিয়ে দেওয়া না যায়। কন্যাশ্রীর টাকায় বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ নইলে আটকানো যাবে না। বিয়েই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়, সেই বোধটা চারিয়ে দিতে গেলে মেয়েদের কাছে কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তাই প্রশিক্ষণ। তাই কন্যাশ্রী যোদ্ধা।

কন্যাশ্রী প্রকল্পে মুর্শিদাবাদের নোডাল অফিসার সায়ক দেব বলছেন, ‘‘স্কুল ছাড়ার পরে অনেক অভিভাবকই মেয়েকে ঠিক মতো পথ দেখাতে পারেন না। তাঁরা মনে করেন, বিয়েই একমাত্র পথ। আমরা সেই মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে চাইছি।’’

জীবন-যুদ্ধের এই তালিম দিতে পাইলট প্রোজেক্ট হিসেবে রাজ্যের মধ্যে প্রথম মুর্শিদাবাদ জেলাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। কর্মসূচির টাকা আসছে রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী প্রকল্প থেকেই। সরকার চাইছে, মুর্শিদাবাদের সাফল্য দেখে রাজ্যের অন্য জেলাগুলিও এগিয়ে আসুক। শ্রম প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলছেন, ‘‘বিয়ে পরে, আগে তো ওরা নিজের পায়ে দাঁড়াক।’’

পঞ্চায়েত ভবনের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বেনজির বলছিল, ‘‘চোখের সামনে ক্লাসের অনেকেরই বিয়ে হতে দেখেছি। কত লোককে বলতে শুনেছি— কন্যাশ্রীর টাকায় বিয়েটা দিতে পারলেই কন্যাদায় থেকে মুক্তি।’’

কন্যা যে ‘দায়’ নয়, সেটাই প্রমাণ করার যুদ্ধে এ বার নেমেছে কন্যাশ্রীর যোদ্ধারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন