সৌজন্যে দমবে না জমির লড়াই

নরেন্দ্র মোদী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক নতুন অধ্যায় দেখে ক্ষুব্ধ রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপি শিবিরে মমতা-বিরোধী নেতাদের বক্তব্য, কেন্দ্র-রাজ্য এই যুক্তরাষ্ট্রীয় বোঝাপড়ার জন্য কি তবে রাজ্যে বিজেপির আক্রমণাত্মক রণকৌশলকে শিকেয় তুলে রাখা হল?

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৫ ০৪:২১
Share:

কলকাতার নজরুল মঞ্চে। — ফাইল চিত্র।

নরেন্দ্র মোদী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক নতুন অধ্যায় দেখে ক্ষুব্ধ রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপি শিবিরে মমতা-বিরোধী নেতাদের বক্তব্য, কেন্দ্র-রাজ্য এই যুক্তরাষ্ট্রীয় বোঝাপড়ার জন্য কি তবে রাজ্যে বিজেপির আক্রমণাত্মক রণকৌশলকে শিকেয় তুলে রাখা হল?

Advertisement

একে তো কলকাতায় গিয়ে সারদা নিয়ে কোনও কথাই বলেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তায় দিল্লি ফিরে সতীর্থ মন্ত্রীদের কাছে মমতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। মোদী বলেছেন, ‘‘মমতা আজও খুবই আন্তরিক, জাতীয়তাবাদী এবং খুবই সহজ-সরল। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকবে। কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ককে মজবুত করার কথা আমি তো প্রথম দিন থেকেই বলে আসছি।’’

রাজ্যে বিজেপি তবে কী করবে? কলকাতা থেকে ফিরে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত তথা ‘প্রভারী’ সিদ্ধার্থনাথ সিংহ এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি অমিত শাহর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সিদ্ধার্থ আজ নিতিন গডকড়ীর সঙ্গেও মধ্যাহ্নভোজন করেছেন। মোদী ও অমিত শাহ সিদ্ধার্থকে জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিজেপির কাজ করুক। এ ব্যাপারে দিল্লির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কোনও ভাবেই রাজ্য নেতৃত্বকে ধীরে-চলো নীতি গ্রহণ করতে বলছে না।

Advertisement

অতীতে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকে রাজ্য সভাপতি করে সিপিএমকে ক্ষমতাচ্যুত করার এক মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিলেন রাজীব গাঁধী। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ার পর জ্যোতিবাবুর সঙ্গে রাজীবের বন্ধুত্বের অধ্যায় শুরু হয়। প্রিয়বাবু ও মমতা সেই বোঝাপড়ায় ক্ষুব্ধ হন। এর পরে নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে মমতা মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফাও দেন ওই একই বোঝাপড়ার অভিযোগ তুলে। রাওয়ের সরকার ছিল সংখ্যালঘু। সরকার বাঁচাতে সিপিএমের কৌশলগত সমর্থন লাভের আশায় রাও তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া করছেন — এই ছিল মমতার অভিযোগ।

বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ মনে করেন, কংগ্রেস জমানার সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির কোনও তুলনা চলে না। কারণ, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব সে সময় মমতার পা টেনে ধরেছিলেন, নির্দেশ দিয়েছিলেন ধীরে চলার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক বার কেন একশো বারবৈঠক করতে পারেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কও শোভন ও সাংবিধানিক হওয়া কাম্য। কিন্তু তা বলে বিধানসভা ভোট যখন দরজায় কড়া নাড়ছে,তখন বিজেপি রণে ভঙ্গ দেবে— এমনটা যাঁরা ভাবছেন তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।

মুখ্যমন্ত্রী মমতারও ঘোষিত অবস্থান হল, বিজেপি তথা এনডিএর সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক আঁতাঁত বা সমঝোতার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। পাশাপাশি মমতা এ-ও বলেছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন নীতির ক্ষেত্রে ‘কেস-টু-কেস’ পর্যালোচনা করাই তো উচিত কাজ। যেমন, জমি বিল নিয়ে আমরা সামান্যতম আপস করতে প্রস্তুত নই।’’

রাজ্য কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলছেন, ‘‘এটা কোনও রাজনৈতিক বোঝাপড়া নয়। এ হল কায়েমি স্বার্থের বোঝাপড়া। তৃণমূল বাঁচতে চাইছে সিবিআইয়ের হাত থেকে। আর মোদী চান রাজ্যসভায় মমতার সমর্থন। এ এক অশুভ আঁতাঁত।’’

সন্দেহ নেই মোদী-মমতা আঁতাঁতের এই অভিযোগে সিপিএম ও কংগ্রেসের কাছাকাছি আসার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সীতারাম ইয়েচুরি সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী মোর্চা গঠনের আলোচনাও শুরু হয়েছে। কিন্তু রাজ্য স্তরে কংগ্রেস নেতারা সে ভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আর রাহুল গাঁধী এখনও পশ্চিমবঙ্গে একলা চলো’ নীতি নিয়েই চলতে আগ্রহী। কংগ্রেস মনে করছে মোদী-মমতা ‘বোঝাপড়ায়’ তাদেরই লাভ, বামেদের নয়। দলের মুখপাত্র অজয় মাকেন ও রাজ্য সভাপতি অধীর চৌধুরী দু’জনেরই দাবি, মোদী-মমতা বোঝাপড়ায় কংগ্রেসের প্রাসঙ্গিকতা বেড়ে গিয়েছে রাজ্যে। সিপিএমের ৩৪ বছরের অপশাসন মানুষ ভোলেননি। আবার বিজেপিও যে আসল ঠিকানা নয়, এ কথাও বাংলার মানুষ বুঝতে পেরে গিয়েছেন।

মমতা সরকারের সঙ্গে সৌজন্য ও সহযোগিতার প্রশ্নে মোদী বলছেন, ‘‘বিষয়টি শুধু রাজ্যসভায় বিল পাশ করানো নয়। এটা আমার নীতি। অখণ্ড ভারত তখনই শক্তিশালী হবে, যখন রাজ্য সরকার শক্তিশালী হবে।’’ মোদী এটাও জানেন, সিপিএম জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকবেই। আর বামেরা যে দিকে, সে দিকে মমতা ঘেঁষবেন না। মুলায়ম সিংহ যাদবের ফোন ও প্রবীণ কংগ্রেস নেতার অনুরোধেও মমতা যে কারণে দিল্লিতে জমি বিল-বিরোধী সমাবেশে যেতে রাজি হননি। এই অবস্থায় কংগ্রেস-বিরোধী রাজনীতির পরিসরে নবীন পট্টনায়ক বা নীতীশের মতো মমতার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাকেই ঠিক রণকৌশল বলে মত মোদীর।

তা হলে রাজ্যে তিল তিল করে জমি দখলের যে চেষ্টা বিজেপি চালিয়ে আসছে, তার কী হবে? কোন পথে এগোবেন সিদ্ধার্থনাথরা? এই প্রশ্নে মোদী-অমিতরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, রাজ্যে জমির লড়াই চলবেই।

অরুণ জেটলি, বেঙ্কাইয়া নায়ডু, নিতিন গডকড়ী, রাজনাথ সিংহের মতো নেতারা মনে করেন সংসদ পরিচালনায় রাজনৈতিক ‘ম্যানেজমেন্ট’ দরকার। কিন্তু সেটা স্বল্পমেয়াদি, স্রেফ কিছু বিল পাশ করানোর জন্য। তাতে বিজেপির দীর্ঘমেয়াদি লড়াইটাকে কোনও ভাবে লঘু করে ফেলা হবে না। আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারেরও অনেকে মনে করছেন, চালাকি করে সরকার চালানোই দলের একমাত্র লক্ষ্য নয়। যে সব রাজ্যে বিজেপির শক্তি কম, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা আছে, সেখানে আরএসএস এবং বিজেপির এখন থেকেই মতাদর্শগত প্রচারে ও সংগঠন বিস্তারে ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার। তবে এটাও ঘটনা, বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের অনেকেই নরম লাইন নেওয়ার পক্ষে, আর আরএসএস উদ্গ্রীব শীঘ্র সংঘাতের পথে যেতে।

দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছ থেকে বার্তা পেয়ে সিদ্ধার্থনাথ আজও মমতা-বিরোধী পরিসরে নিজেদের জমি ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়েছেন। রাজ্যে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে মুখর হয়েছেন তিনি। বিবৃতি দিয়েছেন মমতা সরকারের বিরুদ্ধে। তবে মোদী অতীতে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে বহু কথা বললেও এই কলকাতা সফরে সে প্রসঙ্গ এড়ানোয় রাজ্য বিজেপি অখুশি। তাদের মতে, এতে পরোক্ষ বার্তাটা মমতার পক্ষেই গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ভোটের আগে ও পরে প্রচারের ভাষা ও অগ্রাধিকার বদলায়। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অনেক বেশি। আদালতের নির্দেশে সিবিআই যেখানে যা তদন্ত করছে, তা লঘু করার কোনও প্রশ্নই নেই। আবার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কোনও ব্যক্তি বা সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করারও প্রশ্ন ওঠে না। ওটা কংগ্রেস আমলের মানসিকতা। মোদীর কথায়, ‘‘আমি তো সিবিআইয়ের সঙ্গে দেখাই করি না। ওদের ওদের মতোই কাজ করতে বলি।’’ কেন্দ্র-রাজ্য সাংবিধানিক সম্পর্কের প্রশাসনিক বাস্তবতার দিকটি অস্বীকার করা সম্ভব নয় সিদ্ধার্থনাথের পক্ষে। তবে সেটা মেনে নিয়েও তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘‘২০১৬-র বিধানসভা ভোটের আগে খুব শীঘ্রই বিজেপির আক্রমণাত্মক ভূমিকা আপনারা দেখতে পারেন।’’

মমতাও জানেন, সরকারি ভাবে মোদী সৌজন্যের হাত বাড়ালেও রাজ্যের ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটের কথা মাথায় রেখেই বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব কমানোর ঝুঁকি নেওয়া তাঁর পক্ষে শক্ত। বিজেপি রাজ্যে মমতা-বিরোধী রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেই বরং কংগ্রেস-সিপিএম একজোট হয়ে শক্তিশালী হবে। বাংলায় তাই বিজেপির রাজনৈতিক পরিসর থাকাটা তৃণমূলের স্বার্থেও জরুরি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement