অ্যাসিড-ঘায়ে নগদের ছিটে, দিশাহারা মা-ছেলে

কচি গায়ের বাঁ কানখানা কোনওমতে বাঁচাতে পেরেছেন ডাক্তাররা। গালের পাশ বেয়ে মাথার চুল থেকে বুক, পেট দগদগ করছে এখনও।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৫
Share:

আক্রান্ত মা ও ছেলে। সুরজিৎ এবং গীতা কামাল। ছবি :শুভাশিস ভট্টাচার্য।

কচি গায়ের বাঁ কানখানা কোনওমতে বাঁচাতে পেরেছেন ডাক্তাররা। গালের পাশ বেয়ে মাথার চুল থেকে বুক, পেট দগদগ করছে এখনও। কিন্তু নিয়মমাফিক ড্রেসিং করার একখানা মলম অবধি কিনতে হাঁসফাঁস দিন আনি, দিন খাই পরিবার।

Advertisement

কাজ আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও পকেটে নগদ টাকা নেই। গত পাঁচ দিন ধরে খেটেখুটে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। তাই বাড়ি ফিরে অ্যাসিড হামলার শিকার ১০ বছরের ছেলেটাকে দেখে দিশেহারা লাগছে বাবার। তার সামনে দাঁড়াতে গিয়ে মরমে মরে যাচ্ছেন মন্টু কামাল।

শুধু ছেলে সুরজিৎ নয়। মন্টুবাবুর স্ত্রী গীতাও অ্যাসিড হামলার শিকার। ২৬ অগস্ট বিরাটি স্টেশনে দিনে-দুপুরে হামলাকারীর ছোড়া জ্বলন্ত তরলে পুড়ে গিয়েছিল মা, ছেলে। গীতাদেবীকে উত্যক্ত করতে এসেই অভিযুক্ত পল্টু কর্মকার অ্যাসিড ছোড়ে বলে তদন্তে জানা গিয়েছে। তাকে গ্রেফতার করা হলেও মা-ছেলের সমস্যার সুরাহা হয়নি এতটুকু।

Advertisement

হামলার সময়ে ছেলে ছিল মায়ের কোল ঘেঁষে। তার আঘাতই বেশি মারাত্মক। আর জি কর হাসপাতালে তিন মাস কাটিয়ে এ মাসের গোড়ায় স্টেশন ধারের ঝুপড়িঘরে ফিরেছে দু’জন। কিন্তু পেশায় রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে মন্টুবাবুর মাথার উপরে তত দিনে, প্রায় ৬০ হাজার টাকার ধার।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ— অ্যাসিড হামলার ঘটনায় দিন পনেরোর মধ্যে অন্তত তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য আক্রান্তদের। আর সেই টাকা দেওয়ার কথা সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের। তা তো জোটেইনি। কেন পাননি, তারও সদুত্তর মেলেনি। ব্যারাকপুরের মহকুমা শাসক পীযূষ গোস্বামীর আশ্বাস, ‘‘বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

তার সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নোট-নীতির ধাক্কা। চোখে অন্ধকার দেখছেন অসহায় দিন মজুর। নিজের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়নি এখনও। এ দিকে নোট-চক্করে ঠিকাদারও হাত তুলে দিয়েছেন। জানান, মজুরি নিতে হবে চেকে। দিন মজুরির ৩৫০ টাকা নগদে দেওয়া অসম্ভব বলেছেন তিনি। এই অবস্থায় কী করবেন, মাথায় ঢুকছে না তাঁর।

মন্টুবাবু বলেন, ‘‘একটা মলমের টিউবই ৮৫ টাকা। পুরোটা ফাঁকা করে দিলেও ছেলের ঘায়ের সবটায় মাখানো যায় না।’’ স্ত্রীর বুকপেটে ঘা খানিকটা শুকিয়েছে। কিন্তু ছেলের রোজকার ড্রেসিংটা পর্যন্ত সামলাতে নাজেহাল মা-বাবা। মন্টুবাবুর কথায়, ‘‘ছেলে, বউ দু’জনেরই ওষুধ কেনা বাকি। হাসপাতাল কী সব পরীক্ষা করতে বলেছে। কবে পারব, জানি না!’’

নগদে টানাটানির জেরে আরও ঘোরালো সমস্যা। হাসপাতালে যেতে হচ্ছিল বলে দিনের পর দিন কাজে যেতে পারেননি মন্টু। তার উপরে কিছু দিন আগে ঠিকাদারের গছানো পুরনো ৫০০-র নোটে মজুরি নিয়েও ঘোর বিপদ। তাঁর তো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও নেই। মন্টুবাবু বললেন, ‘‘বিরাটির এক লটারি দোকানদার বলল অচল ৫০০ দিলে দাও! কিন্তু বদলে চারটে ১০০ নিতে হবে। ছেলের মলম, ব্যান্ডেজ কিনতে সেটাও মানতে হল।’’

সরকারি হাসপাতালে তিন মাসে মা-ছেলের আয়াদের খরচ দিনপিছু ৬০০ টাকা! দেবেন কোথা থেকে! সেই বকেয়া ৫৪ হাজার টাকা মেটানোর ক্ষমতা না-থাকায় হাসপাতালের আসল কাগজ কেড়ে নিয়েছেন তাঁরা। সহ্য করে নিতে হয়েছে দিনমজুরকে।

রোজকার জীবনযন্ত্রণা নিত্যদিন বেড়েই চলেছে। আক্রান্ত বালক ও তার পিঠোপিঠি দাদা— দু’জনেরই স্কুল বন্ধ এই ডামাডোলে। কিছু শুভানুধ্যায়ী টুকটাক সাহায্য করছেন। সেটাও চেকে। আত্মীয়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে রাখা সেই টাকা কাজ ফেলে কখন তুলবেন, জানেন না মন্টুবাবু। ধার করে টিকে আছে স্টেশনধারের পরিবার।

ট্রেন ঢুকলে প্ল্যাটফর্ম ঘেঁষা ঝুপড়িতে দিনেও ঘুটঘুটে অন্ধকার নামে। সেই অন্ধকার ক্রমশ ঘিরে ধরছে অসহায় জীবন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন