টাকা নেই হাতে, শীতের বেড়ানো শিকেয়

পরিকল্পনাটা তাই স্থগিত নয়, একেবারে বাতিলই করে দিয়েছেন হিন্দুস্তান রোডের রূপশ্রী দাস। ভেবেছিলেন, বড়দিনের ছুটিতে স্বামী, কলেজপড়ুয়া কন্যা আর বৃদ্ধা মা-কে নিয়ে পুরী যাবেন।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:৩৬
Share:

বৈধ নোটের আকাল আসন্ন শীতের বেড়ানোতেও আঁচ ফেলেছে।

Advertisement

পরিকল্পনাটা তাই স্থগিত নয়, একেবারে বাতিলই করে দিয়েছেন হিন্দুস্তান রোডের রূপশ্রী দাস। ভেবেছিলেন, বড়দিনের ছুটিতে স্বামী, কলেজপড়ুয়া কন্যা আর বৃদ্ধা মা-কে নিয়ে পুরী যাবেন। এ বছর মেয়ের গরমের ছুটিতে ভুটান ঘুরে আসার পর আর কোথাও বেরোনো হয়নি। তিন রাত, চার দিনের জন্য পুরী ঘোরার খরচও খুব বেশি হবে না। সেই মতো নিউ মেরিন ড্রাইভে একটি হোটেলের সঙ্গে প্রাথমিক কর্তাবার্তাও সেরে রাখেন। তবে গত বুধবার, ৯ নভেম্বর দুপুরেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বেড়াতে যাবেন না।

রূপশ্রী দেবীর কথায়, ‘‘শুধু পুরী কেন, আপাতত কোথাও যাচ্ছি না। আগে নোট বাতিলের ধাক্কাটা সামলাই। সব কিছু একটু থিতু হোক। হাতে বাজারঘাট করা, ওষুধ কেনার নগদ টাকাই নেই। এই সময়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবাই বিলাসিতা।’’

Advertisement

গরমের ছুটি, পুজোর ছুটির পর ভ্রমণের তৃতীয় মরসুম শীতের ছুটি ২৪-২৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে যায়। ১ জানুয়ারির পর কিছুটা ছেদ। আবার তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ফের শুরু হয় আর চলে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত।

আসন্ন শীতের সেই পর্যটনকে এ বারে ধাক্কা দিয়েছে বৈধ নোটের জন্য হাহাকার। এখন থেকেই যা মালুম পেতে শুরু করেছেন পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লোকজন। ট্যুর অপারেটরদের বক্তব্য, যাঁরা দু’-তিন মাস আগে থেকে ট্রেন বা বিমানের টিকিট কেটে ফেলেছেন, হোটেল বা লজ বুকিংয়ের জন্য অগ্রিম টাকা জমা করেছেন বড়দিনের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য, তাঁদের প্রায় কেউই কিছু বাতিল করেননি। তবে নতুন বুকিং হচ্ছে না, কিংবা এই সময়ে যত সংখ্যক বুকিং হওয়ার কথা, তার চেয়ে অনেকটাই কম হচ্ছে।

রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেবের কথায়, ‘‘খুব খারাপ অবস্থা। নোট বাতিলের এই সিদ্ধান্তে সব চেয়ে বেশি মার খাচ্ছে পর্যটন শিল্প। এমনটা চললে শীতের মরসুম পর্যটনের পক্ষে মোটেই ভাল যাবে না। কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না।’’ চলতি আর্থিক বছরে রাজ্যের পর্যটন উন্নয়ন নিগমকে ১০ কোটি টাকা মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিলেন মন্ত্রী। গৌতমবাবু এখন বলছেন, ‘‘লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সব ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। কিন্তু নোট নিয়ে এই সিদ্ধান্তে ওই উদ্যোগ ধাক্কা খেল।’’

পর্যটনমন্ত্রী এখন উত্তরবঙ্গে। ২১ নভেম্বরের পর তিনি কলকাতায় আসবেন। তার পর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নবান্নে বৈঠক করবেন। সঙ্কট সামাল দেওয়ার ব্যাপারে ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গেও মন্ত্রী বসবেন বলে পর্যটন দফতর সূত্রের খবর।

শীতের ছুটিতে বাঙালির অন্যতম গন্তব্য উত্তরবঙ্গ, সিকিম, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। সাধারণত ভাল আবহাওয়া আর ঝকঝকে আকাশের জন্যই ভ্রমণপিপাসুরা দার্জিলিং, ডুয়ার্স, মেঘালয়, অসমের কাজিরাঙা বা মানস অভয়ারণ্যে বেড়ানোর জন্য বেছে নেন।

অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজম-এর কনভেনর রাজ বসু বলছেন, ‘‘৯ তারিখ দুপুর পর্যন্তও বুকিং হয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকে আজ পর্যন্ত একটা বুকিংও হয়নি। এমন অবস্থা কবে হয়েছে, মনে করতে পারছি না।’’

গত কয়েক বছরের হিসেব বলছে, উত্তরবঙ্গ ও সিকিম নিয়ে কাজ করা দশ বছরের বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ট্যুর অপারেটর নভেম্বর মাসের এই সময়ে রোজ গড়ে ৫-৬টি বুকিং পান। ইস্টার্ন হিমালয় ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন-এর কার্যকরী সভাপতি সম্রাট সান্যাল জানাচ্ছেন, অন্যান্য বছর এই সময়ে রোজ পাঁচ-ছ’টি বুকিং পান বড়দিনের ছুটির জন্য। এ বার হচ্ছে দিনে বড়জোর একটি বা দু’টি!

আসলে বেড়াতে যাওয়া মানে কেবল প্লেন-ট্রেনের টিকিট কাটা বা হোটেল-রিসর্ট বুকিং নয়। সেগুলোর টাকা অনলাইনে বা চেকেও না হয় দেওয়া যাবে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনোর পর গাড়ি ভাড়া, খাওয়ার খরচ আছে। প্রত্যন্ত গ্রাম বা জঙ্গলের রিসর্টে খাবারের খরচ নগদেই মেটাতে হবে। সেখানে ইন্টারনেট কাজ করে না। আবার কোনও কোনও রিসর্টের সার্ভিস চার্জ, বিলাস করও সেখানে গিয়ে নগদে দিতে হয়, বুকিংয়ের সময়ে জমা নেওয়া হয় না। নগদে মেটাতে হয় জঙ্গলে জিপ সাফারি বা হাতির পিঠে চড়ার টাকাও। এ সব চিন্তা করেই নোটের আকালের সময়ে বহু মানুষ বেড়ানোর কথা ভাবতে পারছেন না।

পর্যটনমন্ত্রী বলেন, ‘‘সরকারি লজগুলো অনলাইনে বুক করা যাচ্ছে। কার্ডে খাওয়ার খরচ মেটানো যাচ্ছে। কিন্তু সংখ্যায় সেগুলো হাতেগোনা। অধিকাংশ পর্যটক টানে বেসরকারি হোটেল-রিসর্ট-হোম স্টে।’’ গৌতমবাবুর সাফ কথা, ‘‘সব খরচ আগাম মিটিয়ে দিলেও বেড়ানোর সময়ে পকেটে যথেষ্ট নগদ টাকা রাখতেই হয়। আর তাতেই আকাল।’’

একটি বেসরকারি ট্যুর অপারেটর সংস্থার অপারেশনস হেড নন্দিনী সেনের মতে, ‘‘বেড়ানোর পরিকল্পনা করতে যে সুস্থির মানসিকতা প্রয়োজন, এই মুহূর্তে বহু মানুষেরই সেটা নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন