হাওয়ায় শিরশিরে আমেজ, ডেঙ্গি তবু হাল ছাড়ছে না। ঋতুবদলের তোয়াক্কা না-করে বহাল তবিয়তে রয়ে গিয়েছে সে। রয়ে গিয়েছে ওই জীবাণু-বাহক এডিস ইজিপ্টাই মশাও। আতঙ্কে কাঁটা হয়ে থাকা সল্টলেক, কলকাতা ও মফস্সলের মানুষের তাই প্রশ্ন, আর কত দিন ডেঙ্গির প্রকোপ চলবে?
ডেঙ্গির মরসুম দীর্ঘায়িত হওয়ার পিছনে কিছু-কিছু ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতার অভাব এবং চিকিৎসকের ‘ভুল’ পদক্ষেপ যেমন রয়েছে, পাশাপাশি স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য গোপন করার প্রবণতা ও পরিকাঠামোর অভাবকেও দায়ী করছেন পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা। আর রয়েছে বৃষ্টি। ওই বৃষ্টিতেই বিভিন্ন এলাকায় মশার আঁতুড়ঘর তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই এলাকাগুলি চিহ্নিত করে মশা মারার কাজটাই হচ্ছে না।
এক চিকিৎসক-কর্তার কথায়, ‘‘স্বাস্থ্য ভবন এই সংক্রমণকে গুরুত্ব না-দেওয়ায় নীচের স্তরেও কাজ হচ্ছে না। ডেঙ্গি আক্রান্ত এলাকায় বাড়ি বাড়ি মশার লার্ভা খোঁজা ও মারা, এলাকার মানুষের রক্ত পরীক্ষা, মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ হচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে রোগ ছড়াচ্ছে।’’
তথ্য গোপনের বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তারাও। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পতঙ্গবাহিত রোগ প্রতিরোধ বিভাগের অধিকর্তা অক্ষয় ধারিওয়াল যেমন বলেন, ‘‘দিল্লিতেও এক বার চিকুনগুনিয়া ছড়িয়েছিল। তখন কিন্তু তারা মৃত বা আক্রান্তের সংখ্যা কম করে দেখায়নি। তাতে মোকাবিলায় সুবিধা হয়েছিল।’’ ধারিওয়াল বলেন, এ বছর পশ্চিমবঙ্গে সব চেয়ে বেশি হচ্ছে ডেঙ্গ-২। এ’টি ডেঙ্গির সব চেয়ে খারাপ ধরনগুলির একটি। এই পরিস্থিতিতে রোগ মোকাবিলা নিয়ে সরকারের সচেতন হওয়া উচিত।
ডেঙ্গির প্রতিষেধক বাজারে না-থাকায় এডিস ইজিপ্টাই মশা নিধনের উপরেই জোর দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। অথচ এই পরিস্থিতিতেও কলকাতা পুরসভা বাদ দিলে গোটা রাজ্যের জন্য স্বাস্থ্য দফতরের মাত্র এক জন অস্থায়ী এন্টোমোলজিস্ট বা পতঙ্গবিদ রয়েছেন! এন্টোমোলজিস্টরাই সারা বছর মশার প্রজননক্ষেত্র খোঁজা, লার্ভা খোঁজা, মশার ভিতর কোনও জিনগত পরিবর্তন হয়েছে কি না, রোগ ছড়ানোর ধরন বদলেছে কিনা, নতুন কোনও বাহক মশা রোগ ছড়াচ্ছে কি না এই সব দেখেন। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর অবশ্য বক্তব্য, ‘‘এন্টোমোলজিস্টের অভাব আমাদের আছে, তবে তাঁদের কাজ জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীদের দিয়েই করানো হচ্ছে। অসুবিধা হচ্ছে না।’’
পরজীবী বিশেষজ্ঞদের অনেকে আবার জানাচ্ছেন, এনএস-ওয়ান পরীক্ষায় ডেঙ্গি পজিটিভ মেলার পরেও অনেক রোগী ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাস্তায়। এনএস-ওয়ান পরীক্ষার ফলকে অবজ্ঞা করাটা বিপজ্জনক হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন জাতীয় পতঙ্গবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনইউবিসিপি)-র এক কর্তা। তিনি বলেন, এনএস-ওয়ান পরীক্ষার ফল পজিটিভ হওয়া মানেই যে কারও ডেঙ্গি হয়েছে— তা যেমন নয়, তেমনই কারও যে ডেঙ্গি হতে পারে, তা সন্দেহ করা যেতে পারে ওই পরীক্ষার ফল দেখে।
ডেঙ্গি সংক্রান্ত তথ্য গোপন করার বিষয়টি মানতে নারাজ বিশ্বরঞ্জনবাবু। তাঁর মন্তব্য, ‘‘কিছু লুকনো হচ্ছে না। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ডেঙ্গিতে ৮ হাজারের মতো আক্রান্ত। মৃত ২৭। বাকি যাঁরা ডেঙ্গিতে আক্রান্ত বা মৃত বলা হচ্ছে, তাঁদের বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। তথ্য পরীক্ষা চলছে।’’ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গি আক্রান্ত ৬ হাজার ৯৬৩ এবং মৃত ২৫ বলে দেখানো রয়েছে। এ ব্যাপারে বিশ্বরঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘ওঁদের তথ্য দেওয়া হয়েছে। ওঁরা তা যোগ না-করলে কী করা যাবে!’’ তবে এত ‘কম করে দেখিয়েও’ চলতি বছর এখ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গই শীর্ষে।