ঢিলে দিলে মারাত্মক হতে পারে ডেঙ্গির দাপট

ডেঙ্গি নিয়ে রাজ্য জুড়ে তৈরি হওয়া আতঙ্ককে সোমবারই ‘অযথা প্যানিক’ বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা কিন্তু বলছেন, যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার, যেখানে সরকারি হিসেবেই মৃত্যু হয়েছে ২৮ জনের, যেখানে অজানা জ্বরে মৃত্যুর খতিয়ান নিয়ে কারও কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই, সেখানে সামগ্রিক ভাবে গোটা বিষয়টিকে লঘু করে দেখা অর্থহীন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৬ ০৪:২২
Share:

ডেঙ্গি নিয়ে রাজ্য জুড়ে তৈরি হওয়া আতঙ্ককে সোমবারই ‘অযথা প্যানিক’ বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা কিন্তু বলছেন, যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার, যেখানে সরকারি হিসেবেই মৃত্যু হয়েছে ২৮ জনের, যেখানে অজানা জ্বরে মৃত্যুর খতিয়ান নিয়ে কারও কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই, সেখানে সামগ্রিক ভাবে গোটা বিষয়টিকে লঘু করে দেখা অর্থহীন। স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ বলছেন, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল তো বটেই, কিছু বেসরকারি হাসপাতালেও ডেঙ্গির চিকিৎসা নিয়ে এখনও যেমন গা-ছাড়া মনোভাবের অভিযোগ রয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্য পরোক্ষে তাকেই আরও প্রশ্রয় দিতে পারে।

Advertisement

ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে, অধিকাংশ হাসপাতাল‌ে জ্বরের চিকিৎসা করাতে যাওয়া রোগীদের একটা বড় অংশকে ‘ও কিছু নয়’ বলে স্রেফ প্যারাসিটামল লিখে দিয়ে বাড়ি ফেরত পাঠানো হচ্ছে! সঠিক নজরদারির অভাবে এঁদের অনেকের অবস্থারই পরে অবনতি হচ্ছে। ডেঙ্গি রোগীদের ক্ষেত্রে সময়ে প্লেটলেট পরীক্ষা না করানোয় পরবর্তী সময়ে এক ধাক্কায় প্লেটলেট অনেকটা কমে গিয়ে বড়সড় ঝুঁকির পরিস্থিতিও তৈরি হচ্ছে বহু ক্ষেত্রে। শনিবার দক্ষিণ কলকাতার একবালপুরের নার্সিংহোমে মন্টু সাউ নামে যে যুবকের মৃত্যু হয়েছে, তাঁর পরিবারের তরফেও অভিযোগ ছিল, শহরের তিনটি সরকারি হাসপাতাল তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাতেই অবস্থা আরওসঙ্গিন হয়।

সমালোচনার মুখে হাসপাতালগুলির তরফেও পাল্টা যুক্তি দেওয়া হচ্ছে এবং তার পুরোটা কিন্তু অস্বীকার করার মতোও নয়। তাঁরা বলছেন, শুধু জ্বরের রোগীতেই ওয়ার্ড উপচে পড়ছে। শয্যা ছাড়িয়ে রোগী ভর্তি রয়েছেন ট্রলিতে, মেঝেতে, বারান্দায়! এই অবস্থায় কিছুটা ‘স্ক্রিনিং’ না করে ভর্তি করে নিলে গোটা পরিষেবাটাই মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু সমস্যা হল, যে সব ক্ষেত্রে ‘স্ক্রিনিং’ যথাযথ হচ্ছে না, সেখানে বাড়ি ফেরার পরে রোগীর অবস্থার অবনতি হচ্ছে। কখনও কখনও মারাও যাচ্ছেন। তাতেই বাড়ছে জনরোষ। পরিস্থিতি এমনই যে মুখ্যমন্ত্রীও মঙ্গলবার এসএসকেএমে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘‘ডেঙ্গি হোক বা না হোক, প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু আগে করুন।’’

Advertisement

প্রশ্ন উঠেছে, এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা বলতে মুখ্যমন্ত্রী কী বোঝাতে চেয়েছেন? সোমবারই বিধানসভায় তিনি জানিয়েছিলেন, সরকার নির্ধারিত পথেই যেন চিকিৎসা হয়। কিন্তু সেই পথটা কী? সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা জানিয়েছেন, সরকারি তরফে এ ব্যাপারে কোনও প্রোটোকল নেই। যে যার নিজের মতো করেই চিকিৎসা করছেন। আর ঘটনা হল, এতেই বিপত্তি বাধছে। যেমন, সোমবার মারা যাওয়া বিজয় বসু রোডের ৮ ও ১২ বছরের দুই ভাই সজ্জন ও বিবেক সাউকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছিলেন চিকিৎসক। তার জেরেই পরিস্থিতি ঘোরালো হয় বলে মত চিকিৎসকদের অনেকের। একই ভাবে সম্প্রতি রাই সাহা নামে কসবার বাসিন্দা আট বছরের যে শিশুর মৃত্যু হয়েছে, তার ক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিকই গোল বাধিয়েছিল বলে জানাচ্ছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই। তা হলে কেন অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে সরকারি তরফে কোনও নির্দেশিকা জারি হচ্ছে না? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী না বললে এ ব্যাপারে আমরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। ওঁকে সবটাই জানানো হয়েছে।’’

স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এর প্রাক্তন অধিকর্তা অমিয় কুমার হাটির বক্তব্য, ডেঙ্গির মরসুম বলতে সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরকে বোঝানো হয়। কিন্তু তার আগেই যা ঘটছে, তাতে গা ছাড়া মনোভাব নিলে তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ডেঙ্গির চরিত্র বদলেছে। চেনা উপসর্গ বদলেছে। তাই রোগের সঙ্গে লড়াই করার জন্য অনেক বেশি সতর্কতা দরকার।’’

চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ বলছেন, ডেঙ্গির সঙ্গে ভাইরাল ফিভার বা চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ মিশে যাচ্ছে। জ্বর বা গাঁটে ব্যথার মতো উপসর্গ বহু ক্ষেত্রেই থাকছে না। কখনও জ্বরও সে ভাবে থাকছে না, তাই প্রাথমিক অবস্থায় রোগটাকে চিহ্নিত করাই কঠিন হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ডেঙ্গিকে নিছক ‘প্যানিক’ বলাটা খুব বিচক্ষণতার পরিচয় নয় বলেই অভিমত চিকিৎসকদের।

মুখ্যমন্ত্রী ‘প্যানিক’ বললেও এ দিন সকালে ডেঙ্গি নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য দক্ষিণ দমদম, দমদম পুরসভা এবং এলাকার বিভিন্ন স্কুল ও ক্লাবকে নিয়ে একটি পদযাত্রা করেন দমদমের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। এই মরশুমে ডেঙ্গির হুল উত্তর ২৪ পরগনার দক্ষিণ দমদমেই সবচেয়ে বেশি বিঁধেছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছিল জেলা স্বাস্থ্য দফতর। ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে সেখানে এক শিশু-সহ চার মহিলার মৃত্যু হয়েছে। যে জন্য জেলা স্বাস্থ্য দফতর তিরস্কার করেছিল দক্ষিণ দমদম পুর কর্তৃপক্ষকে। যদিও পুর কর্তৃপক্ষের দাবি, ডেঙ্গি মোকাবিলায় তাঁরা সব ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু নাগরিকেরা সচেতন না হওয়ায় এলাকায় ডেঙ্গির প্রকোপ বেড়েছে। এ দিন সচেতনতা বাড়াতে মন্ত্রী পদযাত্রার আয়োজন করলেও তাতে হাজির ছিলেন না দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন