খাগড়াগড়ে বিস্ফোরক অ্যাসিড চমকে দিয়েছে গোয়েন্দাদের

ছোট-বড়-মাঝারি নানা মাপের কাচ আর প্লাস্টিকের বোতলে রাখা ছিল জল আর অ্যাসিডের মিশেল। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণস্থল থেকে মেলা এই অ্যাসিডের স্বরূপ জেনে কপালের ভাঁজ বেড়েছে গোয়েন্দাদের। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) গোয়েন্দাদের দাবি, ২,৪,৬-ট্রাইনাইট্রোফেনল বা পিকরিক অ্যাসিড নামে শক্তিশালী ওই বিস্ফোরক দিয়ে ‘ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ (আইইডি) বানাত খাগড়াগড়ের কুশীলবেরা।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১৬
Share:

ছোট-বড়-মাঝারি নানা মাপের কাচ আর প্লাস্টিকের বোতলে রাখা ছিল জল আর অ্যাসিডের মিশেল। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণস্থল থেকে মেলা এই অ্যাসিডের স্বরূপ জেনে কপালের ভাঁজ বেড়েছে গোয়েন্দাদের। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) গোয়েন্দাদের দাবি, ২,৪,৬-ট্রাইনাইট্রোফেনল বা পিকরিক অ্যাসিড নামে শক্তিশালী ওই বিস্ফোরক দিয়ে ‘ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ (আইইডি) বানাত খাগড়াগড়ের কুশীলবেরা।

Advertisement

ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং বাজেয়াপ্ত বিস্ফোরক, রাসায়নিক ও আইইডি-র নমুনা পরীক্ষা করে এনআইএ-র বিশেষজ্ঞদের অনুমান, হাসান চৌধুরীর বাড়ির দোতলায় যে সব বিস্ফোরক ছিল, জনবহুল এলাকায় সে সব এক সঙ্গে ফাটলে বহু প্রাণ যেতে পারত।

গোয়েন্দাদের একাংশ বলছেন, “বিস্ফোরক সম্পর্কে জ্ঞান ও আইডি তৈরির পারদর্শিতার নিরিখে খাগড়াগড়ের জেহাদিরা হার মানিয়ে দেবে জঙ্গি সংগঠন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এর সদস্যদের।” এনআইএ-র যে গোয়েন্দারা মুম্বই-এ ৭/১৩-র ধারাবাহিক বিস্ফোরণ, গত বছর বুদ্ধগয়ায় বিস্ফোরণ ও পটনায় নরেন্দ্র মোদীর সভাস্থলে বিস্ফোরণের তদন্ত করেছেন, তাঁদের দাবি, খাগড়াগড়ের মতো এত ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক দিয়ে এত বেশি শক্তিশালী আইইডি এখনও পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি আইএম।

Advertisement

এনআইএ-র বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন এ পর্যন্ত প্রধানত যে ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করে এসেছে, সেই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিধর পিকরিক অ্যাসিড। বিস্ফোরক ক্ষমতায় আরডিএক্সের চেয়ে সামান্য কম ক্ষমতা এই রাসায়নিকের। খাগড়াগড়ে বসে শাকিল বা সুবহানেরা এই অ্যাসিড কাজে লাগাচ্ছিল রীতিমতো ব্যবহার-বিধি মেনে। নানা মাপের বোতলে জলের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছিল ওই রাসায়নিক। কারণ, অ্যাসিডটি নিজেই বিস্ফোরক। জল ছাড়া রাখা হলে যে কোনও সময়ে বিস্ফোরণ হতে পারে। কাচ-প্লাস্টিকের বদলে ধাতব পাত্রেও এই অ্যাসিড রাখা যায় না। কারণ, বিক্রিয়া করে এমন ধাতব লবণ তৈরি করে, যেগুলি বিস্ফোরক।

এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “খাগড়াগড়ের কীর্তিমানদের রসায়ন সম্পর্কে ভালো জ্ঞান ছিল। আমরা জেনেছি, পিকরিক অ্যাসিডের সঙ্গে আরও কিছু তরল যোগ করে ওরা এক বিশেষ ধরনের মিশ্রণ বানাত। ওই মিশ্রণই ছিল আইইডি-র মূল বিস্ফোরক-উপাদান।” পিকরিক আ্যাসিড ছাড়া আর কী-কী উপাদান মিশিয়ে বিস্ফোরক তৈরি করা হতো, সেটা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা পরীক্ষা করে দেখছেন।

গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, রাসায়নিক হিসেবে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বাজার থেকে পাওয়া সহজ হলেও পিকরিক অ্যাসিড কিন্তু যে কেউ কিনতে পারে না। খনি-খাদানে বিস্ফোরণ ঘটাতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট দিয়ে তৈরি বিস্ফোরক ‘পাওয়ার জেল’ খোলা বাজারে মেলে। তা খাগড়াগড়েও মিলেছে। কিন্তু পিকরিক অ্যাসিড যে কী ভাবে জোগাড় করা হল, গোয়েন্দারা তা ভেবে পাচ্ছেন না।

২০০৭-এর মে মাসে হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদে বিস্ফোরণে পিকরিক অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়েছিল বলে গোয়েন্দারা সন্দেহ করেন। তার কিছু দিনের মধ্যেই ভারতীয় সেনাবাহিনী জম্মু-কাশ্মীরের একাধিক জঙ্গি ঘাঁটিতে হানা দিয়ে প্রচুর পিকরিক অ্যাসিড উদ্ধার করে। সেনা-গোয়েন্দাদের মত, জম্মু ও কাশ্মীরে নাশকতা ঘটাতে হরকত-উল-মুজাহিদিন ও লস্কর-ই-তইবার (এলইটি) মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি এখনও পিকরিক অ্যাসিড ব্যবহার করে। এই প্রেক্ষিত মাথায় রেখে এনআইএ খতিয়ে দেখছে, শাকিলরা জম্মু ও কাশ্মীরে কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর সূত্রে ওই মারাত্মক বিস্ফোরক জোগাড় করেছিল কি না। কারণ, মোবাইলের ‘কল ডিটেলস’ অনুযায়ী, শাকিল বেশ কয়েকবার জম্মু ও কাশ্মীরে ফোন করেছিল। এনআইএ-র এক কর্তা বলেন, “জম্মু ও কাশ্মীরে কোনও যোগাযোগের সূত্রে খাগড়াগড়ে পিকরিক অ্যাসিড পৌঁছে থাকলে বিপদ আরও গভীরে। সে ক্ষেত্রে এলইটি, হরকত মুজাহিদিনের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে খাগড়াগড়ের যোগসূত্রের ইঙ্গিত স্পষ্ট হবে।”

তবে শুধু পিকরিক অ্যাসিড নয়, এনআইএ-কে চিন্তায় রেখেছে ঘটনাস্থল থেকে মেলা প্রায় তৈরি, দেশি প্রযুক্তির একটি রকেট লঞ্চারও। বিস্ফোরণ-কাণ্ডের আগে খাগড়াগড়ের ওই ডেরায় কোনও রকেট লঞ্চার তৈরি করা হয়েছিল কি না এবং হয়ে থাকলে কাকে, কতগুলি দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবিকে গোয়েন্দারা জেরা করবেন।

এনআইএ-র এক তদন্তকারীর কথায়, “খাগড়াগড় মনে হচ্ছে হিমশৈলের চূড়ামাত্র। এর শিকড় কত দূর পর্যন্ত গিয়েছে তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। তবে উদ্ধার হওয়া জিনিসপত্র দেখে চিন্তা হচ্ছে, এ রাজ্য তথা এ দেশের আর কোথায় কোথায় এই সব মারণ-অস্ত্র রয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন