চোখ বুজলেই মেয়ের কান্না, লড়াই মায়ের

বারবার তিনি ফিরে আসেন এই শহরের বুকে। যে শহর কেড়ে নিয়েছে তাঁর একমাত্র সন্তানকে। মেয়েকে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত এক মাকে নিয়ে যখন তোলপাড় দেশ, তখন নিঃশব্দে আর এক মা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর লড়াই।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৩
Share:

বারবার তিনি ফিরে আসেন এই শহরের বুকে। যে শহর কেড়ে নিয়েছে তাঁর একমাত্র সন্তানকে।

Advertisement

মেয়েকে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত এক মাকে নিয়ে যখন তোলপাড় দেশ, তখন নিঃশব্দে আর এক মা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর লড়াই। মেয়ের মৃত্যুর বিচার পাওয়ার লড়াই। কারণ তাঁর কথায়, ‘‘আমার মেয়েকে কষ্ট পেয়ে মরতে হয়েছে। আমি বিচার চাই।’’

উত্তরাখণ্ডের গঢ়বাল জেলার পাহাড় ঘেরা শহর টিহরি। সেখানে এক চিলতে ঘরে ভাড়া থাকেন বছর পঞ্চাশের পুষ্পলতা শর্মা। রুক্ষ, শুষ্ক চেহারা। গত দু’মাসে প্রত্যন্ত সেই পাহাড় বেয়ে তিন-তিন বার এসেছেন কলকাতায়। গত ১৬ জুন তাঁর মেয়ে অনসুলকে কলকাতার বাগুইআটি থানা এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। ময়না তদন্তের পরে প্রাথমিক ভাবে পুলিশের ধারণা হয়, আত্মহত্যা করেছেন অনসুল। মেয়ের এই আত্মহত্যার পিছনে স্পষ্ট প্ররোচনার ঈঙ্গিত পান পুষ্পলতা। সেই থেকে এই শহরের কাছে সন্তান-হারা মায়ের একমাত্র আকুতি— সুবিচার হোক। সেই বিচারের আশাতেই তিনি বারবার আসেন কলকাতায়।

Advertisement

সম্প্রতি একাই পথ খুঁজে পৌঁছে গিয়েছিলেন হাইকোর্টের দোতলায়। সেখানে পুষ্পলতার সঙ্গে দেখা হয় আইনজীবী অদিতি ভট্টাচার্যের। তাঁকেই পুষ্পলতা শুনিয়েছেন তাঁর লড়াইয়ের কাহিনি। অদিতি তাঁর হয়ে লড়ছেন এখন। তাঁর কথায়, ‘‘অসম্ভব জেদ আর মনের জোর এই পাহাড়ি মহিলার।’’

মেয়ে যখন আট মাস পেটে, মারা যান পুষ্পলতার স্বামী। তখন থেকে পাহাড়ি শহরের হাসপাতালে আয়ার কাজ শুরু। নিজের রোজগারেই তিলে তিলে বড় করেছিলেন একমাত্র মেয়ে অনসুলকে। তাকে ঘিরেই ছিল তাঁর বেঁচে থাকা, তাকে ঘিরেই ছিল তাঁর স্বপ্ন। বি-কম পাশ করার পরে মেয়ে বিমানসেবিকা হতে চেয়েছিল। গয়না বেচে দু’লক্ষ টাকা খরচ করে কোর্স করালেন মেয়েকে। কিন্তু পাঁচ বছরেও চাকরি পাননি অনসুল। টিহরির একটি হোটেলেই কাজ শুরু করেন প্রথমে। তার পর এক বান্ধবীর হাত ধরে অনসুল চলে আসেন কলকাতায়।

এখানেও বিমানসেবিকার চাকরি হয়নি। শহরের এক হোটেলে বার-ডান্সারের চাকরি জোটে। বাগুইআটির একটি ফ্ল্যাটে সঙ্গীদের নিয়ে থাকতে শুরু করেন অনসুল। ২০১২ থেকে প্রতি দিনই গিয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে। এ বছরের ১৬ জুন থেমে যায় অনসুলের জীবন। মেয়ের অকাল মৃত্যুর খবর পেয়েই পুষ্পলতা এ শহরে এসেছিলেন প্রথম বার। সঙ্গে দিদি ও বোনপো। মেয়ের শেষকৃত্য সেরে পাহাড়ে ফিরেছিলেন ২০ জুন। কিন্তু লড়াই ছাড়েননি। চোয়াল শক্ত করে অচেনা শহরে ফিরে এসেছেন। পড়ে থেকেছেন দিনের পর দিন। কখনও পুলিশের কাছে গিয়েছেন, কখনও ঘটনাস্থলে গিয়ে মেয়ের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে নিজেই বোঝার চেষ্টা করেছেন মৃত্যুর কারণ। ৫ জুলাই প্রথম বার একা এসেছিলেন তিনি। দু’দিন ধরে শহর চষে খুঁজে বার করেন বাগুইআটি থানা। সেখানে গিয়ে চার জনের নামে অভিযোগ জানান। মেয়ের বন্ধু আরিফ, দেবেন অগ্রবাল, মেয়ের এক রুমমেট ও আবাসনের দারোয়ান। ১৩ জুলাই পুষ্পলতা আবার ফিরে যান টিহরি।

১৬ অগস্ট পুষ্পলতা কলকাতায় আসেন তৃতীয় বারের জন্য। চৌরঙ্গীর এক অতিথি নিবাসে ঠাঁই হয়েছে। ১৭ অগস্ট, একাই উঠে গিয়েছিলেন হাইকোর্টের সিঁড়ি বেয়ে। সেখানেই দেখা অদিতির সঙ্গে। অদিতি জানান, অনসুলকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে সহবাসের অভিযোগ রয়েছে আরিফের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে আরিফ অন্যত্র বিয়ে করে নেন। অভিযোগ, তার পরেও অনসুলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলেন তিনি। অনসুলকে মারধরের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। দুই সন্তানের পিতা দেবেন নামে এক যুবকও বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের জন্য অনসুলাকে জোর করতেন বলে পুষ্পলতার অভিযোগ। আরিফ গ্রেফতার হয় ২২ অগস্ট। পুলিশ হাজতে রয়েছে সে। খোঁজ চলছে দেবেন-সহ অন্যদের। পুষ্পলতার কথায়, ‘‘মেয়ে আমার কাছে কাঁদত। বলত, আমাকে ঠকানো হয়েছে। আমি চোখ বুজতে পারি না। তা হলেই মেয়ের কান্না শুনতে পাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন