আগামী ছ’মাসের মধ্যে রাজ্যে দু’ধরনের অপরাধ কমিয়ে ফেলতে হবে। সেটা ঠিক কতটা, তার পরিমাণও নির্দিষ্ট। রাজ্য পুলিশের ডিজি-র এই লিখিত নির্দেশ সপ্তাহ খানেক আগে প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপার ও কমিশনারদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। আর তা পেয়েই মাথায় হাত পড়েছে পুলিশ কর্তাদের— কী ভাবে এটা সম্ভব!
কত কমাতে হবে অপরাধ? মহিলা নির্যাতন সংক্রান্ত অপরাধ ২০ শতাংশ ও পথ দুর্ঘটনা ৩০ শতাংশ। একেবারে যেন ‘করপোরেট’ সংস্থার বিক্রির টার্গেট বেঁধে দেওয়া। মার্চ মাসে পূর্ণ মূল্যায়ন করা হবে। তার আগে এই দুই অপরাধ কতটা কমলো, জানুয়ারিতে তার খসড়া রিপোর্ট ডিজি-র অফিসে পাঠাতে হবে বলেও ওই নির্দেশে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এমন আজব নির্দেশে বেজায় ফাঁপরে পড়েছেন পুলিশ কর্তারা। ওই নির্দেশ পাওয়ার পর উপরতলার অফিসাররা নিচুতলার কর্মীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে ফেলেছেন। কিন্তু কোন কৌশলে এই দুই অপরাধ কমানো যাবে, কেউই তা ঠাওর করতে পারছেন না। এখনও পর্যন্ত কোনও সমাধান সূত্রও উঠে আসেনি বলে পুলিশ মহলের খবর।
শহর লাগোয়া এক কমিশনারেটের কর্তার কথায়, গত ছ’মাস ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ নিয়ে তো কম প্রচার হল না! এমন কী হেলমেট ছাড়া পেট্রোল না-দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। ওই কর্তার দাবি, তার পরও বাইক আরোহীদের টনক বিশেষ নড়েনি। বিনা হেলমেটে দেদার মোটরসাইকেল চালানো হচ্ছে। দুর্ঘটনাও যেমন হওয়ার তেমনই ঘটছে। দুর্ঘটনায় মৃত্যুও ঠেকানো যায়নি।
লালবাজারের এক পুলিশ কর্তার কথায়, দু’টি বাস রেষারেষি করে দুর্ঘটনা ঘটালে তা আগাম কী ভাবে প্রতিরোধ করা যাবে? অথবা আচমকা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কোনও মোটরসাইকেল বা ট্রাক পথচারীকে ধাক্কা মারলে কী ভাবেই বা তা ঠেকানো যাবে? তাঁর কথায়, ‘‘বড় জোর যান নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি করা যায়। সে ক্ষেত্রেও লোকবলের অভাব রয়েছে। দুর্ঘটনা সামলাতে গিয়ে সার্বিক নজরদারিতে ফাঁক পড়ে যাবে। তাতে চুরি-ডাকাতি বেড়ে যেতে পারে। কী ভাবে কী হবে বুঝে উঠতে পারছি না।’’
এক জেলার পুলিশ সুপারের কথায়, জাতীয় সড়কের অধিকাংশ রাস্তায় আলো নেই। প্রশাসনকে একাধিক বার চিঠি দিয়েও কাজ হয়নি। রাতে মদ্যপ অবস্থায় ট্রাক চালান চালকেরা। মাঝে মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়কে রাতভর নজরদারির উপযুক্ত পরিকাঠামোই নেই। তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় সড়ক ছাড়া রাতে থানা এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর নজরদারিও দরকার। সে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা কী ভাবে কমানো যেতে পারে, কিছুতেই বুঝতে পারছি না!’’ কলকাতা লাগোয়া এক জেলার আর এক পুলিশ কর্তা আবার বলেন, ‘‘ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, বধূ নির্যাতনের মতো ঘটনা অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরেই পুলিশের নজরে আসে। তা কী আগাম নিয়ন্ত্রণ করা যায়!’’ ওই পুলিশ কর্তার কথায়, নজরদারি বাড়িয়ে রাস্তায় ইভটিজিং কমানো যেতে পারে। কিন্তু দুর্ঘটনা ও নারী নির্যাতন কি ঠেকানো যায়?
ডিজি সাহেবের এই নির্দেশ হাতে পাওয়ার পর দক্ষিণবঙ্গের এক জেলার পুলিশ সুপার অধস্তন অফিসার ও নিচুতলার কর্মীদের জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন। পুলিশ সুপার ওই বৈঠকে অফিসার ও কর্মীদের বলেছেন, ‘‘অপরাধ কমানোর কৌশল যদি কারও মাথায় আসে তো জানান।’’ সাত দিন পর ফের বৈঠক করা হবে বলেও নিচুতলার কর্মীদের তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। ওই বৈঠকে অপরাধ কমানোর কৌশল ঠিক করা হবে। ওই পুলিশ সুপারের কথায়, ‘‘নিচুতলার কর্মীরা তৃণমূল স্তরে কাজ করেন। নানা রকম সমস্যা সামলান তাঁরা। সে জন্য ওদের ভাবতে বলেছি। আমার মাথায় তো কিছু আসছে না!’’ তিনি জানান, বৈঠকে এক জন বলেন— কেস না-নিলেই তো হল! অপরাধ কমেছে বলে দেখানো যাবে। কিন্তু সেটা যে করা যাবে না, পুলিশ সুপার সকলকে সেটা জানিয়ে দিয়েছেন।