উন্নয়নের আশা করেন না, তবু ভোট দিতে ঘরে ফেরেন সুন্দরবনের মানুষ

সুন্দরবন এলাকায় ভোট দিতে শহর থেকে গ্রামে ফেরার ঢল নামলো মানুষের। রবিবার সকাল থেকে একটার পর একটা ট্রেন হাসনাবাদ স্টেশনে আসতেই সার সার মানুষ নেমে হাঁটতে থাকেন হাসানবাদ ফেরিঘাটের দিকে।

Advertisement

নির্মল বসু

বসিরহাট শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৪ ০১:২৫
Share:

বাড়ির পথে। রবিবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

সুন্দরবন এলাকায় ভোট দিতে শহর থেকে গ্রামে ফেরার ঢল নামলো মানুষের।

Advertisement

রবিবার সকাল থেকে একটার পর একটা ট্রেন হাসনাবাদ স্টেশনে আসতেই সার সার মানুষ নেমে হাঁটতে থাকেন হাসানবাদ ফেরিঘাটের দিকে। অধিকাংশের কাঁধে, মাথায় ব্যাগ। অনেকে চলেছে ছেলেমেয়েদের হাত ধরে। ইছামতীতে সার সার নৌকা ভাসছে। এক নজরে দেখলে মনে হবে যেন বিজয়াদশমীর ভীড়।

ওই নদী পার হলেই প্রথমে পড়ে পারহাসনাবাদের বিভিন্ন গ্রাম। একটু দুরে হিঙ্গলগঞ্জ ব্লক। আরও একটু এগিয়ে নেবুখালিতে সাহেবখালি নদী পেরিয়ে যাওয়া যায় দুলদুলি, সাহেবখালি, মাধবকাটি, যোগেশগঞ্জ, কালীতলা, সামসেরনগর। সামসেরনগরে আবার দিনরাত বাঘের ডাক শোনেন বাসিন্দারা। কিন্তু ভোটের টানে সেই প্রত্যন্ত এলাকার মানুষও ফিরেছেন এ দিন। দরিদ্র এই এলাকায় কাঠ কাটা কিংবা কিম্বা মাছ-কাঁকড়া ধরা ছাড়া জীবিকা নেই। কাজেই কাজের সন্ধানে অনেকেই পাড়ি দেন বড় শহরে।

Advertisement

কোথা থেকে আসছেন? “গুজরাত” এক হাতে ব্যাগ, অন্য হাতে বাক্স সামলাতে সামলাতে কোনও রকমে উত্তর দিলেন সামসেরনগরের বাসিন্দা গোকুল বৈদ্য। ওই ব্যক্তির কথায়, “এক ফসলি সুন্দরবন এলাকার গ্রামবাসীদের কথা বড় একটা ভাবেন না কোনও রাজনৈতিক দলের নেতারা। কেবলই গাল ভরা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি।” সব জেনেবুঝেও অবশ্য ভোট দিতেই ফিরলেন তিনি গ্রামে। খগেন মণ্ডল, রতন দাসদের কথায়, “গ্রামে কাজ নেই। অথচ জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া। তাই তো আমাদের মতো হাজার হাজার গ্রামবাসীকে ঘর-সংসার ছেড়ে অন্যত্র ছুটতে হয়। অনেকে যেমন ঘরে স্ত্রী-সন্তান রেখে কাজে যান। আবার অনেকে বাড়ির অন্যদেরও নিয়ে যান সঙ্গে। এমনই এক জন মাধবকাটি গ্রামের ভুবন মাহাতো। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকেন আমদাবাদে। স্বামী-স্ত্রীতে মিলে সোনায় নকশা তোলার কাজ করেন। তাঁরাও ফিরেছেন ভোট দিতে। এ দিন দুপুরে হাসনাবাদ ফেরিঘাটে ভিড়ের মাঝে দেখা হলে বললেন, ‘‘এখানকার মতো ভোট নিয়ে মাতামাতি, এ তো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, এমন সাম্প্রাদায়িক উষ্কানিমূলক প্রচার লক্ষ করা যায় না ওখানে। রাজনৈতিক দলগুলির প্রচারের বেশির ভাগটাই জুড়ে থাকে উন্নয়নের কথা।” ভুবনবাবুদের আফসোস, “২০০৬ সালে হাসনাবাদ নদীতে সেতুর শিলান্যাস হলেও আট বছর কেটে গেল। সেতু তৈরি তো দূরের কথা, এখানে এসে শুনছি ভাঙতে হবে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হওয়া পিলার দু’টি। নতুন করে শুরু হবে সেতুর কাজ।”

কানাইকাটি গ্রামের সুধন্য পাড়ুই, কালীতলার বাসিন্দা নিতাইপদ মণ্ডলরা বলেন, ‘‘সেই ছোট থেকে তো ভোট আসলে কেবলই শুনছি এখানে উন্নয়ন উন্নয়ন করে গলা ফাটাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি। কিন্তু এক ফসলির সুন্দরবনকে আজও তো কেউ দো ফসলিতে পরিণত করার ব্যবস্থা করল না। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন কিম্বা পর্য়টনের দিকটাও দেখা হল না। এ সব হলে আর বাসিন্দাদের ঘর-সংসার ফেলে কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে ছুটতে হত না।”

আয়লায় সর্বস্বান্ত হওয়ার পরে রোজগারের আসায় প্রতিবেশীদের কাছে সন্তানদের ফেলে রেখে স্বামীর সঙ্গে মহারাষ্ট্রে কারখানায় কাজে গিয়েছিলেন ভগবতী মণ্ডল। ওই মহিলার কথায়, “উন্নয়ন তো দূরঅস্ত্‌, একটা সেতুর দু’টি পিলার করতে যেখানে আট বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয় না সেখানে আর আশা করার মুখ থাকে না। ওরা কেবল ভোট পেতেই আমাদের বারে বারে মিথ্যা গল্প শোনায়।”

কিন্তু গ্রামে ফিরছেন কেন তা হলে? নৌকায় উঠতে উঠতে কালীতলা গ্রামের বাসিন্দা কমলকৃষ্ণ গোলদার বলে গেলেন, “বাবা-কাকারা বলে গিয়েছেন, ভোট আমাদের জন্মগত অধিকার। তাই তো যেখানেই থাকি, ভোটের সময়ে গ্রামে ফিরি।” অনেকের মুখে আবার ফিসফাস শোনা গেল, “এখানে এসে যা শুনছি, তাতে নিজেদের ভোটটা দিতে পারলে হয়!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন