প্রেমের সাজা হাজত, টের পাচ্ছে রোমিওরা

নাবালিকা, তাই আইনের চোখে তার মতামতের কোনও মূল্য নেই। স্বেচ্ছায় প্রেমিকের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়ে ধরা পড়ে গেলে অপহরণের অভিযোগে প্রেমিকের হাজতবাস আটকানোরও তাই উপায় নেই। বনগাঁ থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বনগাঁ মহকুমায় প্রায় দেড়শোটির মতো এমন ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৪ ০০:৫৩
Share:

অঙ্কন: নির্মাল্য প্রামাণিক।

নাবালিকা, তাই আইনের চোখে তার মতামতের কোনও মূল্য নেই। স্বেচ্ছায় প্রেমিকের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়ে ধরা পড়ে গেলে অপহরণের অভিযোগে প্রেমিকের হাজতবাস আটকানোরও তাই উপায় নেই।

Advertisement

বনগাঁ থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বনগাঁ মহকুমায় প্রায় দেড়শোটির মতো এমন ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। গাইঘাটা থানায় ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪-র এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৫০টি নাবালিকা অপহরণের মামলা হয়েছে। বাগদা থানা এলাকায় এমন নথিভুক্ত ঘটনা রয়েছে প্রায় ২০টি। গোপালনগর থানায় ২০১২ সালের অগস্ট থেকে এখনও পর্যন্ত ৫০টির মতো মামলা হয়েছে। পুলিশের দাবি, তদন্তে দেখা গিয়েছে, সব ক’টি ঘটনার পিছনে রয়েছে প্রেমের গল্প। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাবালিকার সঙ্গে স্কুল বা টিউশন সূত্রে, আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে বা ফোনে যুবকের পরিচয় ঘটেছে। পুলিশের সূত্র বলছে, বেশিরভাগ মেয়েদের গড় বয়স ১৫-১৭ বছর। আর তাদের প্রেমিক মেরেকেটে ২০ থেকে ২৪।

নাবালিকা প্রেমিকাকে ‘অপহরণে’ ধৃত গাইঘাটার এক যুবক জানালেন, ফোনে পরিচয় হয়েছিল মেয়েটির সঙ্গে। সেখান থেকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু সেই সম্পর্ক মেনে নিতে অভিভাবকেরা আপত্তি করলে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করাটাই একমাত্র সমাধানসূত্র বলে মনে হয়েছিল দু’জনের। থানায় গিয়ে ছেলেটির নামে অপহরণের নালিশ করে মেয়েটির পরিবার। ছেলেটিকে গ্রেফতার করে লক-আপে ভরে পুলিশ। বাড়ির লোকের সামনেই মেয়েটি পুলিশকে জানায়, তাকে কেউ অপহরণ করেনি। সে নিজের ইচ্ছায় প্রেমিকের সঙ্গে চলে যায়। তারা বিয়েও করেছে মন্দিরে। কিন্তু নাবালিকার সেই বিয়ে আইনত সিদ্ধ নয়। গ্রেফতার হয় প্রেমিক।

Advertisement

বাগদা থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, নথিভুক্ত ২০টি ঘটনার একটিতেও নাবালিকা বলেনি, তাকে জোর নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অধিকাংশ সময়েই দেখা যাচ্ছে, প্রেমিককে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা করছে মেয়েটি। পুলিশের অভিজ্ঞতা, প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, পালিয়ে গিয়ে মন্দিরে বিয়ে করে আত্মগোপন করে ছিল যুগল। পুলিশ যখন নাবালিকাকে উদ্ধার করে, তখন গায়ে বিয়ের চিহ্ন। অনেক ক্ষেত্রে জেল খাটার পরে ওই নাবালিকাকে নিয়ে যুবক ফের পালিয়েছে, এমন ঘটনারও নজির রয়েছে।

কিন্তু যতই দু’জনের সম্মতিতে বিয়ে হোক না কেন, আটকানো যাচ্ছে না প্রেমিকদের হাজতবাস। পুলিশ জানাচ্ছে, মেয়ে যাই বলুক না কেন, আইনের চোখে নাবালিকার মতামতের কোনও মূল্য নেই। উদ্ধার করার পরে হাসপাতালে পরীক্ষা করিয়ে পুলিশ মেয়েকে আদালতে পাঠায়। বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দি দিয়ে নিজের কথা জানায় মেয়েটি। কিন্তু আইন অনুযায়ী, তাকে বাবা মায়ের সঙ্গে সে ফিরে যেতে হয় বাড়িতে। অথবা ঠাঁই হয় কোনও হোমে। আর ছেলেটির ঠাঁই হয় জেলে। মাসখানেক জেল খেটে জামিনে সে বাড়ি ফেরে।

প্রেমিকের সর্বোচ্চ কী শাস্তি হতে পারে এ ক্ষেত্রে? আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরে মেয়ের পরিবারের তরফে বিশেষ উচ্চবাচ্য করা হয় না। মামলা ক্রমে তামাদি হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মামলা চলাকালীন মেয়েটির আঠারো বছর বয়স হয়ে গেলে সে যদি ছেলেটির সঙ্গে থাকতে চায়, তা হলেও মামলা ‘ডিসমিস’ করে দেন বিচারক। স্মরণাতীত কালে এই মামলায় কারও সাজা ঘোষণা হয়েছে বলে মনে করতে পারলেন না বনগাঁর আইনজীবীরা।

মহকুমা আদালতের পিপি ইনচার্জ সমীর দাস বলেন, ‘‘নাবালিকা আদালতে এসে স্বেচ্ছায় যুবকের সঙ্গে যাওয়ার কথা জানালেও এটা যে অন্যায়, সেটা যুবককে বোঝানোর জন্যই আমরা প্রথমে জামিনের বিরোধিতা করি। পরে অবশ্য জামিন দিয়ে দেওয়া হয়।’

কিন্তু এই ভাবে বিয়ে করা যে অন্যায়, অনেক প্রেমিকই সেটা জানেন না। জানলেও অনেকে আবার সেটা মানসিক ভাবে মেনে নিতে পারেন না। অপহরণের অভিযোগে ধৃত এক যুবকের কথায়, “স্কুলে যাওয়ার পথে দেখা হত। ও-ই এক বান্ধবীর মাধ্যমে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। আমি না করতে পারিনি। পরে পালিয়ে বিয়েও করি। কিন্তু জানতাম না, আঠারো বছরের আগে বিয়ে করা যায় না। বাড়ি থেকেও তো কেউ মেনে নেয়নি। তাই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারতাম?’’ এমনই আর এক যুবক আবার ঈষৎ অনুতপ্ত। বললেন, “জেলে বসে বুঝতে পেরেছি, কাজটা ঠিক করিনি।” কেউ কেউ আবার আইন জানা সত্ত্বেও এমন ঝুঁকি নেন। এক যুবক যেমন বলেন, “জানতাম, ওর এখনও আঠারো হয়নি। তার আগে বিয়ে করা যায় না। কিন্তু এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, বিয়ে না করে উপায় ছিল না। আসলে প্রেমে না পড়লে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না!’’

পুলিশ জানিয়েছে, নাবালিকা বাড়ি ফেরার পরে দুই পরিবারের সদস্যেরা অনেক সময়ে আলোচনা করে মিটমাট করে নেন। তাতে টাকা-পয়সার লেনদেনও থাকে অনেক ক্ষেত্রে। মেয়ের আঠারো বছর বয়স হলে তাঁর সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন নাবালিকার অভিভাবকেরা। তবে পরে সেই প্রতিশ্রুতি মানা হয় কিনা, তার খতিয়ান অবশ্য পুলিশ রাখে না।

পুলিশ জানায়, এই রকম বিয়ে আটকাতে কিছু দিন আগেই স্কুলপড়ুয়া ও অভিভাবকদের নিয়ে সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল। মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে আবার অনেক দরিদ্র পরিবার অভিযোগ দায়ের করে না। পুলিশ জানিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে ছেলেটির পরিবারেরও অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। কিছু না জেনেই তাঁরা জেল খাটেন। এক পুলিশ কর্তার মন্তব্য, “অভিভাবকদের এ ব্যাপারে আরও সচেতন হওয়ার দরকার আছে।”

উত্তর ২৪ পরগনার চাইল্ড লাইনের হাবরা সাব সেন্টারের অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর হিরন্ময় বিশ্বাস বলেন, “জেলায় বিভিন্ন স্কুলে সচেতনতা শিবির করছি আমরা। মেয়েদের বোঝানো হচ্ছে, সাবালিকা হওয়ার আগে বিয়ে করলে কী শারীরিক-সামাজিক সমস্যা হয়। এ ছাড়া, এ ভাবে মেয়েদের পাচার-চক্রও রয়েছে। বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন।” তিনি জানান, অসুবিধায় পড়লে ১০৮৯-- এই হেল্প লাইনে নম্বরে ফোন করে তাঁদের কাছে নাবালক-নাবালিকারা সমস্যার কথা জানাতে ব্যবস্থা নেবেন তাঁরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement