SIR in West Bengal

ভোটের উৎসব, উৎসবেও ভোট, অষ্টমীর অঞ্জলির সময়েও ফোন আসবে না তো! উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ বয়ে পুজো এসেছে ভোটকর্মীর

পুজো মিটলেই এইআরওদের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা মৌখিক ভাবে জেনেছেন অনুলেখা এবং তাঁর মতো আধিকারিকেরা। তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কমিশনকে নির্দিষ্ট প্রশ্ন করার। সেই প্রস্তুতি নিতেই নবমীর দুপুরে তাঁরা কয়েক জন বসবেন মধ্যমগ্রামের এক সহকর্মীর বাড়িতে।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৮
Share:

ছবি: এআই সহায়তায় প্রণীত। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলেন গত ২৮ অগস্ট। এক আত্মীয়ার বাড়িতে সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। মধ্যাহ্নভোজের মধ্যে ফোন এল প্রশ্ন নিয়ে: ১২১ নম্বর বুথের ‘ডিসপিউট’ সংখ্যা কত? খাওয়া মাথায় উঠেছিল তাঁর। দ্রুত তথ্য ঘেঁটে জবাব দিতে হল।

Advertisement

তারই পিঠোপিঠি এক রবিবার আত্মীয়কে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। আবার ফোন! শেষ সাত দিনে কত ‘হিয়ারিং’ হয়েছে? বুথভিত্তিক সংখ্যা কত? হাসপাতালের কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় জবাব খুঁজে বের করে জানাতে জানাতেই শেষ ‘ভিজিটিং আওয়ার’।

বাড়ি ফিরবেন। অফিস থেকে বেরিয়েছেন সবে। সহকর্মীর ফোন, ‘‘এখনই আসুন। সামারি রিপোর্ট চাইছে ওই অফিস থেকে।’’ আবার অফিস। ‘সামারি রিপোর্ট’ তৈরি করে পাঠাতে পাঠাতে রাত সাড়ে ৮টা।

Advertisement

তিনটি ঘটনারই পাত্রী এক। বছর ছাপ্পান্নর অনুলেখা মুখোপাধ্যায়। রাজ্য সরকারের একটি দফতরের পদস্থ কর্মচারী। সেই কারণেই তাঁর আসল নামটি লেখা গেল না। কিন্তু ভোটের কাজ করতে গিয়ে তাঁর জীবনে যা যা ঘটছে, সব আসল। তার মধ্যে কোনও খাদ নেই।

যেমন খাদ নেই তাঁর পুজো-উৎকণ্ঠায়। মঙ্গলবার, মহাষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়ার সময়েও এমন কোনও ফোন আসবে না তো! এলে তো ফুল-বেলপাতা ফেলে রেখে তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে হবে। সে জবাব দিতে দিতে যদি অঞ্জলির লগ্ন পেরিয়ে যায়!

দক্ষিণবঙ্গের একটি বিধানসভার ৪২টি বুথ অনুলেখার দায়িত্বে। তাঁর পদের পোশাকি নাম ‘এইআরও’ (অ্যাসিস্ট্যান্ট ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার)। পরিস্থিতি যা, তাতে প্রায় সারাক্ষণ তাঁকে মুখ গুঁজে রাখতে হচ্ছে ভোটার তালিকায়। এর আগেও ভোটের কাজ করেছেন অনুলেখা। কিন্তু এ বার তার সঙ্গে মিশে থাকছে উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ।

হাওড়ার বাড়িতে বসে ভোটার তালিকা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা বলছিলেন অনুলেখা। তাঁর ঘরটাই অবশ্য একটা দৃশ্য। গোটা বিছানা জুড়ে ছড়ানো ভোটার তালিকা। রং-বেরঙয়ের বুকমার্ক লাগানো। সেই সঙ্গে নোট্‌সের তিনটি ডায়েরি। পুজোর আগের রবিবার বা অন্য ছুটির দিনেও বাড়িতে বসে ভোটার তালিকার কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। স্বামী সদ্য অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মচারী। তিনিও কিঞ্চিৎ সাহায্য করছেন। তবে বাড়ির যে ঘরে বসে ভোটার তালিকার কাজ করতে হচ্ছে অনুলেখাকে, সে ঘরের দরজার সামনে দাঁড় করাতে হয়েছে একটি সাড়ে চার ফুট উচ্চতার প্লাইউডের দেওয়াল। যাতে পোষ্য ‘হুতুম’ ঢুকতে না-পারে। কারণ, ইতিমধ্যেই কিছু ভোটার তালিকা আপনমনে চিবিয়ে ফেলে অনুলেখার কাজ বাড়িয়ে দিয়েছে সে।

এত উৎকণ্ঠা কেন? উদ্বেগ কী নিয়ে?

অনুলেখার ভনিতাহীন জবাব, ‘‘চার আধিকারিক সাসপেন্ড হয়ে গিয়েছেন। সেটা আমার মতো অনেককেই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। অবসর নিতে আর সাড়ে তিন বছর বাকি। এই বয়সে এসে টেনশন তো হবেই!’’ কিন্তু যাঁরা নিলম্বিত হয়েছেন, তাঁরা তো কারচুপিতে অভিযুক্ত। কারচুপি হলে তো ব্যবস্থা তো নেওয়া হবেই।

এই অনুলেখা খুলে বসলেন তাঁদের কাজের প্রক্রিয়ার পুঁথি। বুথস্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ, সেই তথ্য পোর্টালে তোলার ক্ষেত্রে ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের ভূমিকাও জুড়ে থাকে যে প্রক্রিয়ায়। বুথ ধরে, ভোটার ধরে সমস্ত তথ্য মিলিয়ে দেখা কঠিন। সেটাই করতে হচ্ছে তাঁর মতো এইআরও-কে। অনুলেখার কথায়, ‘‘দীর্ঘ দিনের জমা আবর্জনা রাতারাতি সাফ করার অভিযান শুরু হয়েছে। উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু বলার নেই। কিন্তু বাস্তবায়নের পরিকঠামো নেই। ফলে আমরা পড়েছি জাঁতাকলে।’’

সে দোধার তলোয়ারের এক দিকে নির্বাচন কমিশন, অন্য দিকে রাজ্য সরকার। এখন কাজে ভুল হলে কমিশন ধরবে। আবার এ-ও ঠিক যে, ভোট ফুরোলে কমিশন আর থাকবে না। তখন সরকারই সব।

কথাবার্তা চলতে চলতেই অনুলেখার পুত্র ঘরে এসে মাকে ছাতুর শরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। ২৪ বছরের তরুণ সফ্‌টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কর্মরত ছিলেন নিউটাউনে। সংস্থা বদলে যাবেন বেঙ্গালুরুতে। লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন যাওয়া। অনুলেখার ইচ্ছা ছিল নতুন শহরে ছেলেকে ঠিকঠাক কোনও জায়গায় রেখে একটু গোছগাছ করে দিয়ে আসবেন। উপায় নেই। মায়ের ইচ্ছা দমিয়ে দিয়েছে সরকারি কর্মীর উৎকণ্ঠা। অনুলেখার কথায়, ‘‘শুনছি পুজোর পরে আরও জোরকদমে কাজ শুরু হবে। ট্রেনিংও পড়তে পারে। তাই আর যাওয়ার ঝুঁকিটা নিতে পারছি না।’’

এসআইআর কি হবে? অনুলেখার জবাব, ‘‘কিছু একটা হবে। আমাদের ট্রেনিংয়ে যা বলা হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে, কিছু একটা হবেই।’’ অনুলেখার অধীনেই কাজ করছেন একাধিক বিএলও (বুথ লেভেল অফিসার)। নতুন নিয়মে তাঁদের কাজ নিয়েও বিড়ম্বিত তিনি। এত দিন পর্যন্ত আশাকর্মী এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা ওই কাজ করতেন। এ বার তাঁদের বাদ দিয়েছে কমিশন। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মতো সরকারি কর্মীদের বিএলও করা হয়েছে। যাঁদের বুথস্তরে এলাকা ঘুরে তথ্যসংগ্রহের তেমন কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। এসআইআর হলে তাঁদের নামতে হবে ময়দানে। সেখানেও কী হবে তা নিয়েও নানা আতঙ্ক কাজ করতে শুরু করেছে। এলাকায় বিএলও-র সঙ্গে যদি ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক কর্মীরা জুটে যান, তা হলে তাঁদের অঙ্গুলিহেলনেই কাজ করতে হবে। এবং তার সম্ভাবনা সমূহ বলেই মনে করছেন অনুলেখা।

বিছানায় ছড়ানো ভোটার তালিকাগুলির মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিধানসভার ১৩৪ নম্বর বুথের তালিকা খুঁজছিলেন। পেলেন না অনুলেখা। টেবিল থেকে একটি লাল ফোল্ডার নিয়ে এলেন। দেখালেন, সেই ১৩৪ নম্বর বুথে গত এক বছরে যে ৬৭টি নতুন নাম উঠেছে, সেগুলির সাপেক্ষে কোনও তথ্যই নেই। অথচ নাম উঠে গিয়েছে। সেই নামের ভোটারদের কাছে পৌঁছেও গিয়েছে ‘এপিক কার্ড’। এখন তথ্য যাচাইয়ের জন্য তাঁদের যখন ডাকা হচ্ছে, বেশির ভাগই আসছেন না। আবার এক বার নাম উঠে গেলে তা পোর্টাল থেকে সরাসরি বাদ দেওয়ারও সুযোগ নেই। কারণ, নির্দিষ্ট নাম নিয়ে নির্দিষ্ট নম্বর ফর্মে অভিযোগ জমা পড়তে হবে। তার পরে সে সমস্ত খতিয়ে দেখে তবেই বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া করা যাবে।

পুজো মিটলেই এইআরও-দের একটি বিশেষ ট্রেনিং হওয়ার কথা মৌখিক ভাবে জেনেছেন অনুলেখা এবং তাঁর মতো আধিকারিকেরা। তাঁরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কমিশনকে নির্দিষ্ট প্রশ্ন করার। সেই প্রস্তুতির জন্যই নবমীর দুপুরে তাঁর মতো কয়েক জন এইআরও আলোচনায় বসবেন মধ্যমগ্রামের এক সহকর্মীর বাড়িতে। সেই আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি হবে প্রশ্নমালা।

গত কয়েক বছর ধরে আর পুজো প্যান্ডেলে যান না অনুলেখা। তবে পুজোয় তাঁর বাড়িতে লোকজন আসেন। অনুলেখার সহোদরা আমস্টারডাম প্রবাসী। তিনি এবং তাঁর পরিবার পুজোর সময় একটা দিন আসেন অনুলেখার বাড়ি। কিন্তু এ বার তাঁদের আসতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, পুজোয় তিনি নিজে বাড়ি থাকবেন কি না, অনুলেখা তো সেটাই জানেন না! হয়তো অফিস ছুটতে হবে না। কিন্তু পুজোর পরে অফিস খুললে যে কাজগুলো করতে হবে, সেগুলো পুজোর মধ্যেই সেরে রাখতে চান অনুলেখা। পুত্রের আবদার ছিল, বেঙ্গালুরুবাসী হওয়ার আগে পুজোর মধ্যেই বাবা-মাকে গাড়ি চালিয়ে পুরুলিয়া ঘুরিয়ে আনবেন। অনুলেখা বারণ করে দিয়েছেন। যে আত্মীয়-পরিজনদের এত দিন হাতে ধরে পুজোর নতুন পোশাক কিনে দিতেন, এ বার তাঁদের নতুন জামার মূল্য ধরে ‘জি-পে’ মারফত টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

অনুলেখাদের মতো ভোটকর্মীদের পুজো আর উৎসব নয়। বরং তা বয়ে এনেছে উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ। মঙ্গলবার অষ্টমীর অঞ্জলির মন্ত্রের তাল কাটবে না তো?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement