উৎসবের শহরে আজও ব্রাত্য ওরা

শহরের কয়েক হাজার বারোয়ারি দুর্গাপুজোর মধ্যে এখনও পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটিতে হুইলচেয়ারের জন্য র‌্যাম্প রয়েছে। বাকিগুলির ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থাই নেই। আর তাই পুজোর আলো ঝলমলে সন্ধ্যায় ওই শিশুরা ঘরবন্দিই থাকতে বাধ্য হয়।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৭ ০২:৩৫
Share:

অবশেষে: ঠাঁই মেলেনি বড় পুজোয়। ছোট মণ্ডপে মায়ের সঙ্গে দেবস্মিতা। নিজস্ব চিত্র

শুধু এ রাজ্য তো নয়, ভিন্ দেশ থেকেও যে কার্নিভাল দেখতে লোকজন ভিড় করেছেন এ শহরে, সেই কার্নিভালে তাঁদের সন্তানেরা ব্রাত্য কেন? শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ওই শিশুদের জন্য কেন উদ্যোক্তাদের তরফে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই প্রশ্ন পৌঁছে দিতে চেয়েছেন প্রতিবন্ধী শিশুদের বাবা-মায়েরা। তাঁদের অভিযোগ, শুধু তো কার্নিভাল নয়, যেখানে কোটি কোটি টাকা খরচ করে দুর্গাপুজো হয়, সেখানেও মণ্ডপে ঢোকার ক্ষেত্রে ওই শিশুদের কথা ভাবা হয় না। তাই মণ্ডপে ঢুকে প্রতিমা দর্শনের মতো বিসর্জনের কার্নিভালে হাজির থাকার ইচ্ছাও ওই শিশুদের অধরাই থেকে যায়।

Advertisement

শহরের কয়েক হাজার বারোয়ারি দুর্গাপুজোর মধ্যে এখনও পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটিতে হুইলচেয়ারের জন্য র‌্যাম্প রয়েছে। বাকিগুলির ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থাই নেই। আর তাই পুজোর আলো ঝলমলে সন্ধ্যায় ওই শিশুরা ঘরবন্দিই থাকতে বাধ্য হয়। অভিযোগ, মঙ্গলবারের কার্নিভালেও ছবিটা কার্যত এমনই ছিল। ইতিমধ্যেই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একাধিক সংগঠনও।

পাঁচ বছরের মেয়েকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে রেড রোডের ওই কার্নিভালে পৌঁছনোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন ভবানীপুরের সৌম্য মজুমদার। কিন্তু অনুষ্ঠানের ধারে-কাছে পৌঁছতে পারেননি। বললেন, ‘‘আমার মেয়ে পুজোয় এক দিনও ভিড় ঠেলে বেরোতে পারেনি। ওকে কথা দিয়েছিলাম, কার্নিভালে নিয়ে আসব। আসার পরে বুঝলাম, কথা দেওয়া উচিত হয়নি।’’ অনুষ্ঠান শুরুর ঘণ্টা দুই আগে ১২ বছরের ছেলেকে নিয়ে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছিলেন বাগুইআটির তৃপ্তি দাস। ভিড় দেখে ভয় পেয়ে ফিরে আসেন। তৃপ্তির কথায়, ‘‘আগের বার টিভিতে অনুষ্ঠান দেখে আমার ছেলে বায়না ধরেছিল। তাই এ বার ওকে নিয়ে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু এ সব আনন্দ যে ওদের জন্য নয়, সেটা ওখানে পৌঁছে আবার টের পেলাম।’’

Advertisement

তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের প্রতিমন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন অবশ্য এই সব অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর দাবি, ‘‘কার্নিভালে সব ব্যবস্থা ছিল। ৮০ হাজার দর্শকের জন্য তো আর র‌্যাম্প করা যাবে না। যত জনের দরকার ছিল করেছি।’’

দুর্গাপুজোর জন্য যে সব পুরস্কার চালু রয়েছে, তার অনেকগুলিতেই বেশ কিছু শর্ত রাখা হয়। সে সব শর্তের মধ্যে বায়ো টয়লেট যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে প্রতিবন্ধীদের জন্য র‌্যাম্পের ব্যবস্থাও। অভিযোগ, এর মধ্যে অধিকাংশ পুজোই এ সব শর্ত মানে নিয়মরক্ষার জন্য। দক্ষিণ কলকাতার এক পুজো কমিটির সদস্য যেমন স্বীকার করে নিলেন, ‘‘আমাদের মণ্ডপে র‌্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছতে যতটা রাস্তা পেরোতে হয়, সেটাই বেশ ঝঞ্ঝাটের। সন্ধ্যার ভিড়ে তো পৌঁছনো অসম্ভব, এমনকী দিনের বেলাতেও র‌্যাম্পে পৌঁছতে পারাটা বেশ কঠিন। শর্ত পূরণের জন্য কোনও মতে আমরা নিয়মরক্ষা করি।’’

পুজোর ভিড়ে এই ‘নিয়মরক্ষা’র শিকার স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি আক্রান্ত দেবস্মিতা ঘোষ। সাত বছরের দেবস্মিতার মা মৌমিতা বলেন, ‘‘পুজোর থিম নিয়ে এত মানুষের এত রকম চিন্তাভাবনা! কেন কেউ ভাবেন না যে আমাদের সন্তানদেরও পুজোর ক’টা দিন আনন্দ করার সমান অধিকার রয়েছে? যত দিন তা না হবে, তত দিন দুর্গাপুজো ‘সর্বজনীন’ হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।’’

অটিজম আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠানের তরফে অমৃতা পাণ্ডা বলেন, ‘‘এই ‘স্পেশ্যাল’ বাচ্চাদের জীবনে পুজো বলে কিছু নেই। আমরা মূল স্রোতে ফেরানো নিয়ে এত কথা বলি, আসলে তা যে নেহাৎই কথার কথা, তা এই সব অনুষ্ঠানে এলে বড় বেশি প্রকট হয়ে পড়ে। যারা হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে, তাদের জন্য তো বটেই, এমন কী শারীরিক সমস্যাযুক্ত যে ছেলেমেয়েরা হুইলচেয়ারে চড়ে না, তাদের জন্যও যে আলাদা ব্যবস্থা দরকার সেটা কেউ ভাবেন না। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখা ওদের পক্ষে সম্ভব নয়, সেটা উদ্যোক্তারা কবে বুঝবেন, সেই অপেক্ষায় আছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন