ধর্মে ধর্মে মিলটাই বেশি, একমত হলেন ওঁরা

সচরাচর এমন দৃশ্য দেখা যায় না! ইহুদি ধর্মশিক্ষক দিল্লির জুডাহ হিয়াম সিনাগগের র‌্যাবাই এজেকিয়েল মালেকারের কথা শুনে হাততালি দিলেন নাখোদা মসজিদের ইমাম মহম্মদ শাফিক কাশমি।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২২
Share:

আলোচনা সভায় কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সচরাচর এমন দৃশ্য দেখা যায় না!

Advertisement

ইহুদি ধর্মশিক্ষক দিল্লির জুডাহ হিয়াম সিনাগগের র‌্যাবাই এজেকিয়েল মালেকারের কথা শুনে হাততালি দিলেন নাখোদা মসজিদের ইমাম মহম্মদ শাফিক কাশমি। মুগ্ধ হয়ে ঘাড় নাড়লেন চিন্ময় মিশনের প্রধান স্বামী নিখিলানন্দ সরস্বতী, কলকাতার আর্চবিশপ থমাস ডিসুজা, মেদিনীপুরের রামকৃষ্ণ আশ্রম ঠাকুরবাড়ির অধ্যক্ষ স্বামী জয়নানন্দেরা। প্রায় শিকাগো-বক্তৃতায় স্বামী বিবেকানন্দের ঢঙে সব ধর্মের হয়ে সওয়াল করার ভঙ্গিতেই এজেকিয়েল বললেন, ‘‘আমি এখানে মোটেও ইহুদি ধর্মের লোক হিসেবে আসিনি! কে বলেছে, ধর্মীয় পরিচয়টা শেষ কথা? আমি আগে ভারতীয়, তার পরে ইহুদি!’’ এর পরেই ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী’-র শ্লোক আউড়ে গোটা প্রেক্ষাগৃহ ও মঞ্চের সহ-বক্তাদের সকলের তারিফ কুড়িয়ে নিলেন তিনি।

নাখোদা মসজিদের ইমামসাহেবের কথাগুলোও আজকের ধর্ম-রাজনীতির সংঘাতে যুদ্ধদীর্ণ দুনিয়ায় মলম হতে পারে। সরস ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘যথার্থ মুসলমানের একটাই মানে, ‘মিস্টার নো প্রবলেম’! যাঁর জুবান (কথা) ও হাতে অন্য কারও ক্ষতি হয়, তিনি কখনও মুসলমান হতে পারেন না।’’ শুনে গোটা প্রেক্ষাগৃহ হাততালি দিয়ে উঠল।

Advertisement

সম্প্রতি সমুদ্রের ধারে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা সিরিয়ার উদ্বাস্তু শিশু আয়লান কুর্দির মৃতদেহের ছবির সামনে যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দুনিয়ার নানা কিসিমের জাতিধর্মের ধ্বজাধারীদের কিচিরমিচির। সে-ছিল গভীর যন্ত্রণার ঐক্য। কলকাতার রবিবাসরীয় সন্ধে, সল্টলেকের পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতিকেন্দ্রের প্রেক্ষাগৃহ— তার সামান্য পরিসরে বিবিধ মানুষের বিভেদের মধ্যেও ঐক্যের সত্তা খুঁজতে হাত বাড়াল।

‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ ভঙ্গিতে এই সন্ধের ধরতাইটা আগেই দিয়ে রেখেছিল আলোচনাসভার সংগঠক পশ্চিমবঙ্গের শ্রী সত্যসাঁই সেবাসংঘসমূহ ও শ্রী সত্য সাঁই ট্রাস্ট। আলোচনার বিষয়বস্তু— ‘বৈচিত্র্রের মধ্যে ঐক্য: বাঁচার সঠিক রাস্তা’। খানিকটা মিথ-ভাঙার ভঙ্গিতে নান্দীমুখটুকু করলেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি সত্য সূর। শ্রী সত্য সাঁইয়ের জীবনচর্যার সূত্র ধরেই বললেন, ‘‘তিনি কোনও বিশেষ ধর্মের লোক ছিলেন না। বরং ছকে-বাঁধা সত্তার ঊর্ধ্বে যাওয়ার কথাই বলেছেন।’’

পরে বিষয়টা আরও খোলসা করলেন ভারতীয় বায়ুসেনার প্রাক্তন প্রধান, এয়ার চিফ মার্শাল নির্মলচন্দ্র সোনি। বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের সামনে সকলের জন্যই দিশার সন্ধান করে তিনি বললেন, ‘‘মানুষ পাখির মতো উড়তে বা মাছের মতো সাঁতরাতে শিখেছে, এখন সংবেদনশীলতা বুকে ভরে পৃথিবীর মাটিতে মানুষের মতো হাঁটার পথ খুঁজছে।’’ কলকাতার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, ম্যানেজমেন্ট সংস্থার পড়ুয়াদের কাছ থেকেও প্রশ্ন উঠল, ঈশ্বরবিশ্বাস বা আধ্যাত্মিকতার কতটুকু দাম? বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য কি আদতে দুর্বলতা?

ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কোনও ধর্মের প্রতিনিধিই নিজের ধর্মের হয়ে ব্যাটিং করার নামগন্ধ করলেন না। ইমামসাহেব বলছিলেন, ‘‘বৈচিত্র ছাড়া সমাজে তরক্কি (উন্নতি) হয় না।’’ কলকাতার আর্চবিশপের উপলব্ধি, ‘‘ধর্মে-ধর্মে অমিলের থেকে মিলটাই বেশি!’’ ‘‘নিজের প্রতি বিশ্বাস, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বিশ্বাসটাও জরুরি!’’— বললেন নিখিলানন্দ সরস্বতী। রামকৃষ্ণের ভাবধারা উস্কে স্বামী জয়ানন্দের নিদান, ‘‘অন্যের ঈশ্বরকেও নিজের ঈশ্বর বলে ভাবতে হবে।’’ শিঙা ফুঁকে ঐক্যের ডাক দিলেন র‌্যাবাই এজেকিয়েল।

ভাবনার এই উদার আকাশ সব সময় কেন নেমে আসে না পৃথিবীর মাটিতে? এ দিনের সভা যেন তারও উত্তর খুঁজল। সত্য সাঁইয়ের জন্ম ও কর্মভূমি পুত্তাপর্তির একটি পরিবারের বৌমা, কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর তুললেন সাঁইয়ের জীবনদর্শনের কথা— ‘‘কথা ও কাজে মিলটাই হল আসল ধর্ম!’’ গভীর উপলব্ধির এমন নানা মুহূর্তই ছড়িয়ে রইল রবি-সন্ধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন