ডানলপ খোলার জন্য গত বছর রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে হওয়া ত্রিপাক্ষিক চুক্তিটি যে কার্যকর হবে না, তা চুক্তি স্বাক্ষরকারী সব পক্ষই জানত। পাওনা আদায়ের একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
প্রায় আশি বছরের প্রাচীন ডানলপ কারখানা খোলার জন্য গত অগস্টে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি করেছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু সে চুক্তি কার্যকর করার কোনও ক্ষমতা তখনই কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল না। তা জানা সত্ত্বেও সেই চুক্তি ‘সফল’ বলে তৃণমূল সরকার দাবি করে এসেছে। বাম, ডান শ্রমিক ইউনিয়নগুলো গোটা ব্যাপারটা ভাঁওতা জেনেও ‘শ্রমিকস্বার্থ রক্ষা’র দাবি করে এসেছে। কিন্তু শ্রম আদালতে সংস্থার অবসরপ্রাপ্তদের বকেয়া আদায়ে একটি মামলা হতেই থলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল। তখন জানা গেল, গত বছর সেপ্টেম্বরের চুক্তিটি যে কার্যকর হতে পারে না, তা সব পক্ষই জানতেন।
ডানলপ কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের বকেয়া গ্র্যাচুইটি আদায়ের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের গ্র্যাচুইটি আইনে একটি মামলা হয় শ্রম দফতরের চুঁচুড়া শাখায়। গত ২৭ নভেম্বর তার শুনানি ছিল। সে দিন ডানলপ কর্তৃপক্ষের তরফে কেউ না-আসায় শুনানি স্থগিত হয়ে যায়। চুঁচুড়া শ্রম দফতরের সহকারী শ্রম কমিশনার (এই মামলার নিয়ন্ত্রক আধিকারিক) দেবাশিস মণ্ডল বলেন, ‘‘ওই দিন শুনানি না-হওয়ার জন্য চলতি মাসের ১২ তারিখ আর এক বার শুনানির দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু ডানলপের তরফে ১১ ডিসেম্বর একটি চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু সেটি ছিল ২৫ নভেম্বরের তারিখ দেওয়া। তাতেই বলা হয়, ওই সংস্থা লিকুইডেশনে রয়েছে বলে ২৭ নভেম্বরের শুনানিতে তারা আসতে পারবে না। অদ্ভুত ব্যাপার। এক মাস পর দ্বিতীয় দিনের শুনানির আগে এক মাস আগের প্রথম শুনানিতে হাজির না-হওয়ার চিঠি পাঠিয়ে দায় সারল ওরা।’’
ওই চিঠিতে কী বলেছেন ডানলপ কর্তৃপক্ষ? বলা হয়, ‘‘সংস্থা বর্তমানে লিকুইডেশনে রয়েছে। সংস্থার সদর দফতরও কার্যত লিকুইডেটরের অধিকারে। ফলে সেখান থেকে কোনও রকম তথ্য, ফাইল ইত্যাদি বার করা অসম্ভব। তাই, লিকুইডেশনের মামলা চলার জন্য গ্র্যাচুইটি মামলার শুনানিতে আমাদের কিছু বলার পরিস্থিতি নেই।’’
এক মাস পরে এই চিঠি পাওয়ার পর শ্রম আধিকারিক হতভম্ভ হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘‘তখন আমার কিছু করার ছিল না। তাই আগামী ফেব্রুয়ারিতে আর একটি দিন জানিয়েছি শুনানির জন্য। ওই দিনে ডানলপের লোকজনকে আসতেই হবে।’’
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ২০১৩-র ২ মে হাইকোর্ট ডানলপ কোম্পানি গুটিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও রাজ্য সরকার কোন যুক্তিতে সংস্থার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করলেন? শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক ছিলেন ওই চুক্তির অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী। তিনি নিজে আইনজীবী। এক বছর পর তিনি বলছেন, ‘‘কলকাতা হাইকোর্ট লিকুইডেশনের রায় দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আপিল হয়। ফলে সম্পূর্ণ লিকুইডেশন হয়েছে বলা যায় না। তাই শ্রমিকস্বার্থে সরকার চুক্তিতে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু রুইয়া গোষ্ঠী চুক্তির কোনও শর্তই মানেনি, এটাই দুর্ভাগ্যজনক।’’
গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর সাহাগঞ্জের কারখানায় রাজ্য শ্রম দফতর এই ত্রিপাক্ষিক চুক্তি করায়। সে দিনই কারখানার দরজা খুলে যায়। কিন্তু তার পর কি কোনও কাজ হয়েছে? সিটুর হুগলি জেলা সম্পাদক শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘না, সে দিন থেকে আজ অবধি কোনও কাজ হয়নি। কেউ একটা পয়সাও পায়নি।’’ কিন্তু চুক্তিতে স্বাক্ষর করার আগে কি তাঁরা জানতেন যে ডানলপ ইন্ডিয়া তত দিনে লিকুইডেশনের মামলায় ফেঁসে গিয়েছে এবং সেই কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করা কি উচিত ছিল? জবাবে সিটু নেতা বলেন, ‘‘এটা সাংবিধানিক প্রশ্ন। আমরা আসলে চেয়েছিলাম, যে কোনও ভাবে কারখানাটা চালু হোক। তাই সরকারের হাতে হাত মিলিয়েছিলাম। হ্যাঁ, আমরা জানতাম লিকুইডেশনের বিষয়টা।’’
শাসক দলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র স্থানীয় নেতা বিদ্যুত্ রাউতও জানতেন গোটা চুক্তিটাই অকার্যকর হবে। তিনি বলেন, ‘‘কারণ হল, লিকুইডেটরের অনুপস্থিতিতে ওই চুক্তি ঠিক আইনসঙ্গত হচ্ছে না জানতাম। তবু কারখানার কর্মীরা যদি কিছু বকেয়া পেয়ে যান, তার জন্যই চুক্তিতে রাজি হই। কিন্তু রুইয়া গোষ্ঠী মারাত্মক অসত্, অমানবিক, আমি দায়িত্ব নিয়ে এই অভিযোগ করছি।’’
ডানলপ কি সত্যিই লিকুইডেশনে রয়েছে? ২০১৩-র ২ মে ডানলপকে কোম্পানি গুটিয়ে ফেলার (লিকুইডেশন) জন্য কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেয়। এই প্রশ্নের জবাবে সংস্থার জনসংযোগ বিভাগের মুখপাত্র ধ্রুবজ্যোতি নন্দী বলেন, ‘‘লিকুইডেশনে আছে, আবার নেইও। দুটোই ঠিক।’’ এ রকম হেঁয়ালির উত্তর জানতে চাইলে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘লিকুইডেশন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। আমরা তার বিরোধিতা করেছি। ফলে সেই মামলা চলছে। হাইকোর্টের লিকুইডেটর স্পেশাল অফিসারের অধিকারে আমাদের সদর দফতর। তাই মামলা চলাকালীন আমরা আমাদের সদর দফতর থেকে কোনও ফাইল বা নথিপত্র নাড়াচাড়া করতে পারি না। সেটাই বলা হয়েছে ওই চিঠিতে।’’ কিন্তু মামলা চলার ফলে কারখানা খোলার আইনগত ক্ষমতা নেই জেনেও রাজ্য সরকারের ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে কর্তৃপক্ষ কেন স্বাক্ষর করলেন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি মুখপাত্র।
এই বিষয়টি নিয়ে প্রাক্তন আইনমন্ত্রী সিপিএমের রবিলাল মৈত্র বলেন, ‘‘যে সংস্থাকে হাইকোর্ট লিকুইডেশনে পাঠানোর রায় দিয়েছে, তার সঙ্গে আমরা চুক্তি করতাম না। ডানলপ কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ে জিতে এলে তবেই কারখানা খোলার চুক্তি করা উচিত ছিল। এটা ঔচিত্যের প্রশ্ন, নীতির প্রশ্ন। তৃণমূল সরকার গোটা বিষয়ে শ্রমিকদের ভাঁওতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওই চুক্তি করিয়েছে। সেটা যে ভাঁওতাই ছিল, তা প্রমাণ হয়েছে।’’
কোম্পানি বিষয়ক আইনজীবী সঞ্জয় বসু বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট যদি হাইকোর্টের রায় কার্যকর করার উপর স্থগিতাদেশ জারি করে, তা হলে বন্ধ সংস্থার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কারখানা খোলার চুক্তি করা যায় ঠিকই। আইনে তাতে বাধা নেই। কিন্তু সেখানে দেখতে হবে কারখানা খোলার জন্য এবং কর্মী ও পাওনাদারদের বকেয়া মেটানোর কোনও প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল কি না। ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে যদি তা না থাকে তা হলে ওই চুক্তির কোনও মানে নেই।’’
তবে কংগ্রেসের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের বক্তব্য, ‘‘গ্র্যাচুইটি আইনের মামলায় যে চিঠি দিয়েছে কোম্পানি, তাতেই রহস্য লুকিয়ে আছে। সংস্থা লিকুইডেশনে রয়েছে, কর্তৃপক্ষের এ কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে লিকুইডেটরের কাছে পাওনার জন্য দাবি জানানো উচিত কর্মীদের। কর্মীরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে জানতে চান, লিকুইডেশনের উপর স্থগিতাদেশ বহাল আছে কি না। কর্তৃপক্ষ বলছে, সংস্থা লিকুইডেশনে গিয়েছে। তা হলে তাদের হাতে তো কোনও ক্ষমতাই নেই। তারা কোম্পানি খোলার জন্য ত্রিপাক্ষিক চুক্তি করল কেন? রাজ্য সরকার সব জেনেশুনে এই চুক্তি করে শ্রমিকদের প্রতি অপরাধ করেছে।’’