পাঁচমুড়ায় রোদে শুকোনো হচ্ছে ঘোড়া। ছবিটি তুলেছেন শুভ্র মিত্র।
“বাঁকুড়ার ঘোড়া তোকে কে করেছে সৃষ্টি/ চারপায়ে ছুটে যাস কত যে তেপান্তর/ শিল্পীর হাতে গড়া বাংলার কৃষ্টি/ এ ঘোড়াকে ধরবে কে? আছে কার হিম্মত/ জাগিয়েছে রাঢ ভূমি বাঙ্গালি সমাজকে/ কুড়ার ঘোড়া তুই হৃদয়ের সম্পদ”-এ শুধু কবির কথা নয়। বাঁকুড়ার ঘোড়া এখন বিশ্ববাসীরই সম্পদ হয়ে গেছে। আর পোড়ামাটির ঘোড়া তৈরির সেই গ্রাম ‘পাঁচমুড়া’ তারই সূত্র ধরে পেয়ে গেছে বিশ্বখ্যাতি। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের ড্রয়িংরুমেও স্থান পেয়ে গেছে লম্বা ঘাড়ের উপর অহঙ্কারী মুখমণ্ডলের সেই ঘোড়া। ভারতের সেন্ট্রাল কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন বহু দিনই হল, এই পোড়ামাটির ঘোড়াকেই তাদের লোগো হিসেবে ব্যবহার করছে।
কিন্তু বছর কয়েক হল এই গ্রামের শিল্পীরা সঙ্কটে পড়েছেন। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা একসময় এদের তৈরি শিল্পগুলি কেনাকাটা করত। এখন সেটা কমেছে। পরিবর্তে বেসরকারি সংস্থার উপর বেশি করে নির্ভরশীল হতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন শিল্পীরা। কারণ, খরচ অনুপাতে অত্যন্ত কম দামে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাদের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে শিল্পসামগ্রী।
গ্রামে প্রায় ৪৫টি পরিবার এই জীবিকার ওপর নির্ভরশীল। ওই সব পরিবারের অন্তত ২৫০ জন সদস্য এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। গ্রামে ঢুকে যে শিল্পীর ঘরেই পা রাখবেন, সকলেরই একই কথা—“এই শিল্পের দাম নেই। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া নকল পোড়ামাটির শিল্পীরা বাজারটাই নষ্ট করে দিয়েছেন।”
গ্রামে ঢুকতেই দেখা বিশ্বনাথ কুম্ভকারের সঙ্গে। বাড়ির সামনে সদ্য গড়ে তোলা ঘোড়া, হাতি ও মনসার চালি রোদে দিচ্ছেন। তিনি বললেন, “কলকাতায় প্রচুর সমঝদার ক্রেতা আছেন। কিন্তু খোদ কলকাতাতেই টালিগঞ্জ, উল্টোডাঙ্গা, হরিদেবপুরের মতো জায়গায় এখন বাঁকুড়ার নকল ঘোড়া তৈরি হতে শুরু করেছে। ফলে পাইকারেরা কেন এত দূরে কিনতে আসবেন?’’ তিনি জানিয়েছেন, যাঁরা আসছেন, তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই আমাদেরকম দাম দিতে চাইছেন। নকল হলেও কলকাতায় হাতের কাছেই শিল্পসামগ্রীগুলি পেয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। ফলে যে ক’জন পাইকারি ব্যবসায়ী আসেন দামে না পোষালেও একরকম বাধ্য হয়েই তাঁদের কাছে নিজেদের শিল্পকাজ বিক্রি করতে হয়।”
ঠিক এ কারণেই শিল্পীদের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ প্রবীণ শিল্পী সুবলের। তুলনায় বয়সে নবীন জহর, রবি বা ছায়া, মায়া বা সুতপাদেবীর মতো শিল্পীরা। মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে আপন মনে ঘোড়ার পা বানাতে বানাতে প্রবীণ জয়ন্তীদেবী বলেন, “মাটি সংগ্রহের খরচ বেড়েছে। দাম বেড়েছে জ্বালানির। সে ভাবে কাজের দাম পাচ্ছি কোথায়?” ফলে দারিদ্র তাড়া করছে তাঁদের।
এমনকী পূর্বপুরুষের শিখিয়ে যাওয়া এই পেশা ছেড়ে অনেকে চায়ের দোকানে কাজ নিতেও বাধ্য হচ্ছেন। এমনই এক জন পোড়ামাটি শিল্পী ভোম্বল কুম্ভকার বলেন, “সামান্য পুঁজিও নেই। পাইকারি ব্যবসাদাররা অগ্রিম দেন না। তার উপর মালপত্র কেনার পরেও টাকা ফেলে রাখেন। বাধ্য হয়েই চা-মিষ্টির দোকানে কাজ নিয়েছি।” জাতীয় পুরস্কার পাওয়া শিল্পী রাসবিহারী কুম্ভকারের নাতি বাউলদাস কুম্ভকার হনলুলু আকাদেমি অব আর্টসের আমন্ত্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন। তিনি নিজে এবং তাঁর পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য রাজ্য সরকারের পুরস্কারে সম্মানিত।
বাউলদাসও বললেন, “পাঁচমুড়ার বাঁকুড়ার ঘোড়ার নাম করে বাজারে যথেচ্ছে ভাবে বিকোচ্ছে কলকাতা বা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি নকল ঘোড়া। ফলে আমাদের বাজার সঙ্কুচিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার তো কোনও উপায় নেই। ফলে একটা জাঁতাকলে পড়ে আমরা মার খাচ্ছি।”
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে তাঁরা পাঁচমুড়ার শিল্পীদের নিয়ে একটি সমিতিও গড়েছেন। সমিতির সভাপতি ব্রজনাথ কুম্ভকার বলেছেন, ‘‘কী ভাবে আরও বেশি পাইকারি ব্যবসায়ীদের টেনে আনা যায় এবং সরকারি বিপণন সংস্থাকে দিয়ে আরও বেশি করে আমাদের শিল্পসামগ্রী কেনানো যায়, তা নিয়েই চিন্তা-ভাবনা চলছে।” ব্রজনাথবাবু বলেন, “আরও একটি সমস্যা কাঁচামালের অভাব। মাটি মিলছে না। মিলছে না জঙ্গলের পাতার জ্বালানি।” এগুলির পর্যাপ্ত জোগানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পোড়ামাটির শিল্পীরা এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমাদের কয়েক জনের কিছু জমি আছে। সেই সব কাঁকুড়ে মাটি মেশানো, একফসলি। বছরে একবারই অল্প চাষ হয়। সব্জি বলতে সামান্য আলু। তাই পোড়ামাটির শিল্প কাজই আমাদের ভরসা।” সেটার বাজারও এ ভাবে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় চিন্তায় পড়েছেন তাঁরা,—“নকল ঘোড়াতেই যদি মজে যায় ক্রেতাদের মন, আমরা তা হলে এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?”