কারবালার মেলার জন্যই পুজোয় ডবল মজা

মোদকদের পারিবারিক কালীপুজোতেও চোদ্দো আনা অতিথিই মুসলিম। ২৫ বছর আগে স্বপনের ছোট বোন শিখার বিয়েতে সাতভাই চম্পার মতো আগলে ছিলেন পড়শিরা। বেল্লাল শেখ, কাশেম শেখ, খেদের আলিরাই পরিবেশন করেন! কেউ মারা গেলে রামনগরে গঙ্গার ঘাট অবধি কাঁধ দিতেও ভরসা তাঁরাই!

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০২:৫৬
Share:

আট দশক পার করেও নামটা পড়া যাচ্ছে! তারাপদ মোদকের ইঁদারার গায়ে খোদাই করা—

Advertisement

মিস্ত্রি আব্দুল গফুর, শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়!

অক্ষরগুলোর ঘেঁষাঘেঁষি বড়ই প্রতীকী। নদিয়ার শেষ প্রান্তে পলাশির মুলুক-লাগোয়া গাঁ ছোটকুলবেড়িয়া। দাদুর প্রাণের বন্ধুর কথা বলতে চোখ চিকচিক করে তারাপদর নাতি স্বপনের। গফুরদাদু ছিলেন ইঁদারার মিষ্টি জলের মতোই মিষ্টি মানুষ!

Advertisement

সেই একবারই রেগে কাঁই তিনি। দেশভাগে এ গ্রাম তখন কোন দিকে পড়বে ঠিক নেই। তারাপদ ভেবেছিলেন জমিজমা বেচে সপরিবার পাততাড়ি গুটোবেন। গফুর কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘সে কক্ষনও হবেনিকো! মোটেও যেতেও পারবা না, তোমরা!’

মোদকদের আর পা সরেনি।

আরও পড়ুন: উৎসবে প্রাণ তাঁদের গড়া অলঙ্কার-প্রদীপে

গাঁয়ের ১১০০ ঘর মুসলিমের মাঝে মোদক-বাড়ি সবার চেনা। হিন্দু ঘর বরাবর একটিই! গ্রামের সব বিয়ের পাকাদেখায় গলা অবধি নেমন্তন্ন না-খেয়ে মোদকদের ছাড় নেই। পাশের পাড়ার আদুরি বিবি চোখ মোছেন, ‘‘আমার অ্যাসিডে পোড়া মেয়ের জন্য ক্ষতিপূরণ তো স্বপনকাকুই হাইকোর্টের উকিলবাবুকে ধরে জোগালেন।’’

মোদকদের পারিবারিক কালীপুজোতেও চোদ্দো আনা অতিথিই মুসলিম। ২৫ বছর আগে স্বপনের ছোট বোন শিখার বিয়েতে সাতভাই চম্পার মতো আগলে ছিলেন পড়শিরা। বেল্লাল শেখ, কাশেম শেখ, খেদের আলিরাই পরিবেশন করেন! কেউ মারা গেলে রামনগরে গঙ্গার ঘাট অবধি কাঁধ দিতেও ভরসা তাঁরাই!

‘তোর মনে আছে খেদের, কৃষ্ণনগরে ঠাকুর দেখতে গিয়ে আমার মাসির বাড়িতে কী হয়েছিল!’ ষাটোর্ধ্ব খেদের আর স্বপন তখন আঠেরোর তরুণ! কবেকার পুজোর গন্ধ ভাসিয়ে নিয়ে যায়! ‘কী মিছে কথাই বলতে পারিস তুই স্বপন, মাসিমার সঙ্গে আলাপ করাতে লকাই মানে লকিবুদ্দিনকে দেখিয়ে বললি, নকুল ঘোষ! আর আমি কি না, খগেন!’

সে-কালে পাড়াগাঁয়ের ঘরে ভিন ধর্মের অতিথির থাকা নিয়ে আড়ষ্টতা ছিল। কিন্তু স্বপন, খেদের, লকিবদের তাতে থোড়াই কেয়ার। সারা সন্ধে কৃষ্ণনগরে পুজো দেখার পরে পলাশিতে ফেরা মুশকিল! স্বপনের মাসির বাড়িতে শুয়ে শুয়ে নিজেদের জোর হাসাহাসি!

ইঁদারা থেকে ‘টিউকলে’র যুগেও সেই গলাগলি শরতের রোদ হয়ে ঝরে! পুজোয় উজ্জ্বল রহমান, সুজন শেখ, টুটন শেখ, গোকুল শেখদের ছেড়ে থাকার কথা স্বপনের ভাইপো দীপও কি ভাবতে পারেন! মহসিন শেখের ছোট ছেলেটা জন্ম থেকে মোদক-বাড়িতেই মানুষ! ওর দাদা সফিকুলের সঙ্গে মিলিয়ে স্বপনের ভাই বিমল ছেলের নাম রাখলেন গোকুল। জন্ডিসের পর গোকুল শেখের মুখে মাছমাংস রোচে না! বন্ধুরা খ্যাপায়, ‘‘গোকুল তুই তো খাঁটি বোষ্টম রে...!’’ দীপের মা-কাকিমারা বিকেল-বিকেল চাঁদু বিবি, ময়না বিবিদের নিয়ে ইঞ্জিনভ্যানে পলাশি স্টেশন লাগোয়া মীরাবাজারে পাড়ি দেবেন। আর হাজরাপোতা, হসপিটাল মাঠ, রায়বাড়ির পুজোয় ভোগের খিচুড়ি-ঘুগনির শালপাতা চেটেপুটে সুজন, টুটন, গোকুল, ইসমাইলদের সঙ্গেই বারবার লাইন দেবেন দীপ।

কিলোমিটার দেড়েক দূরেই পলাশির যুদ্ধের সৌধ। নবাবের দেশে দুর্গোৎসবের সময়ে মহরমে ‘কারবালার মেলা’র মহিমাও কম নয়। জারি গানের ‘পিয়াসনামা জঙ্গে’র সুর আনমনে গুনগুন করেন স্বপন! ‘‘হিন্দি গানের দাপটে এখন কি না কান ঝালাপালা!’’

জারি গানের সুর ফিকে হয়েছে ঠিকই! তবে মীরাবাজারে মণ্ডপ-অভিযানের ফাঁকেই গ্রামে বচ্ছরকার নাটকের মহলা চলবে। মনোজ মিত্রের নাটকে নাদুসনুদুস টুটন হয়ত যমরাজ, গোকুল পুলিশ, আর দীপ প্রম্পটারের গুরুদায়িত্বে। কারবালার মেলার জন্যই পুজোর মজাটা ডবল এ গ্রামে!

মহরমে নাটক, সবুর আলির মাজারে সুতো বাঁধা, বিশ্বকর্মায় গাড়িপুজো, দুগ্‌গা ভাসানের ডান্স— একাকার ছোটকুলবেড়িয়ার জীবনে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement