চার ক্লাব অ্যাকাউন্টে তালা ইডি-র, নিঝুম ময়দান

এত দিন ক্লাবের কর্তাদের ডেকে হিসেব চাওয়ার মধ্যেই তদন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। এ বার ইডি নিজেই সটান ঢুকে পড়ল ক্লাবের কোষাগারে! সোমবারই কিংফিশার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করেছিল ইডি। মঙ্গলবার আরও তিনটি ক্লাব মোহনবাগান, ভবানীপুর এবং কালীঘাটের অ্যাকাউন্টও সিল করে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। পুজোর ছুটি পড়ে যাওয়ায় ইডি-র অফিসাররা অনেকেই অবশ্য ছুটিতে চলে গিয়েছেন।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২৬
Share:

এত দিন ক্লাবের কর্তাদের ডেকে হিসেব চাওয়ার মধ্যেই তদন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। এ বার ইডি নিজেই সটান ঢুকে পড়ল ক্লাবের কোষাগারে!

Advertisement

সোমবারই কিংফিশার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করেছিল ইডি। মঙ্গলবার আরও তিনটি ক্লাব মোহনবাগান, ভবানীপুর এবং কালীঘাটের অ্যাকাউন্টও সিল করে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। পুজোর ছুটি পড়ে যাওয়ায় ইডি-র অফিসাররা অনেকেই অবশ্য ছুটিতে চলে গিয়েছেন। তাই তিনটি ক্লাবেই এ নিয়ে কোনও চিঠি এ দিন রাত পর্যন্ত পৌঁছয়নি। কিন্তু ভবানীপুর ছাড়া বাকি দুই ক্লাবের কর্তারাই তাদের নিজস্ব সূত্র থেকে জেনে গিয়েছেন খবরটা। কারণ ইস্টবেঙ্গলের মতো মোহনবাগান এবং কালীঘাটের কর্তাদের ডেকেও এর আগে জেরা করেছিল ইডি।

উপর্যুপরি চার-চারটি ক্লাবের উপরে এমন ধাক্কায় পুজোর ময়দানে রীতিমতো হতাশার ছায়া। ধাক্কাটা এতটাই প্রবল যে, সারদা কেলেঙ্কারির জেরে বাংলার ফুটবলই লাটে উঠবে কি না, তাই নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। এমনিতেই স্পনসরের অভাবে ক্লাবগুলির অবস্থা খুবই খারাপ। বেশ কয়েকটি ক্লাব উঠেও গিয়েছে। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ক্লাব প্রায় দু’শো কোটি টাকা স্পনসরশিপ হিসাবে পেয়েছিল বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার কাছ থেকেই। মোহনবাগান ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করে দিলে ফুটবলারদের পেমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে সিকিম গোল্ড কাপে টিম পাঠানো হবে না।

Advertisement

দুই প্রধান ক্লাব ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান-এর দাবি, তারা যা করেছে নিয়ম মেনেই করেছে। প্রধান স্পনসর ইউবি-র সঙ্গে তাদের কো-স্পনসর হিসেবে এসেছে সারদা বা অন্য অর্থলগ্নি সংস্থা। দুই প্রধানের কর্তারাই প্রশ্ন তুলেছেন, নিয়ম মেনে অর্থলগ্নি সংস্থাকে স্পনসর হিসেবে নেওয়া কি অপরাধ? তা হলে কেন এই হেনস্থা? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের প্রভাবশালী কর্তারা বলছেন, “ইডি কি চায় কোটি কোটি সমর্থকের আবেগ-জড়ানো ক্লাবগুলো বন্ধ হয়ে যাক? ওঁরা এসে এক বার ক্লাব চালিয়ে দেখিয়ে দিন না!”

অনেকে আবার প্রশ্ন তুলেছেন, সর্বভারতীয় ক্রিকেট সংস্থা বিসিসিআই তো অর্থলগ্নি সংস্থা সহারা থেকে কয়েকশো কোটি টাকা স্পনসরশিপ হিসেবে নিয়েছে। তা হলে কেন বিসিসিআইয়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করে দিচ্ছে না ইডি বা সিবিআই?

অন্যতম শীর্ষ কর্তা দেবব্রত সরকার জেলে যাওয়ার পর ইস্টবেঙ্গল কর্তারা এমনিতেই সমস্যায় ছিলেন। ইডি এ বার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করে দেওয়ার পর মঙ্গলবার দুপুরে জরুরি সভায় বসেন ক্লাবের সচিব, সহসচিব এবং অন্য পদাধিকারীরা। সিদ্ধান্ত হয়, ক্লাবের দৈনন্দিন কাজকর্ম চালানোর স্বার্থে সিল করা অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার জন্য ইডি-কে চিঠি দেওয়া হবে। সেই চিঠি বিকেলে পৌঁছেও দেওয়া হয় সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে।

চিঠিতে তিনটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এক) ক্লাবের সব ফুটবলারের পেমেন্ট ওই অ্যাকাউন্ট থেকে হয়। ফুটবলাররা পেমেন্ট বন্ধ হলে তাঁরা খেলবেন না। দুই) ক্লাবে র্যান্টি মার্টিন্স, ডুডু-সহ অনেক বিদেশি ফুটবলার খেলেন। তাদের পেমেন্ট না দিতে পারলে ফিফা-য় অভিযোগ জানাতে পারেন ওঁরা। তাতে ক্লাব সাসপেন্ড হয়ে যাবে। তিন) ইস্টবেঙ্গল অত্যন্ত ঐতিহ্যমণ্ডিত ক্লাব। প্রচুর সাফল্য। সেটা মনে রাখা উচিত ইডি-র।

ক্লাবসচিব কল্যাণ মজুমদার এ দিন বলেন, “তদন্তের সময় যা যা কাগজপত্র ইডি চেয়েছে, আমরা দিয়েছি। তদন্তে সাহায্য করছি। সারদার সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি হয়েছে, তার কপিও দিয়েছি। তার পরেও কেন ওঁরা এমন করলেন জানি না।” সামনেই ইস্টবেঙ্গল দেশের দু’টি বড় টুর্নামেন্ট ফেড কাপ এবং আই লিগে অংশ নেবে। র্যান্টি-মেহতাবরা মাসমাইনের চেক না পেলে পরের টুর্নামেন্টে খেলতে যাবেন কি না, তা নিয়ে রীতিমতো সন্দিহান লাল-হলুদ কর্তারা। পুজোর পরেই খেলোয়াড়দের চেক দেওয়ার কথা।

মোহনবাগানের আবার শিয়রে সমন। ফেড কাপ-আই লিগ দূরে। কিন্তু পুজোর পরেই সিকিমে টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়ার কথা কাতসুমি-সোনি নর্ডিদের। মোহনবাগান সচিব অঞ্জন মিত্র বললেন, “আমরা এখনও কোনও চিঠি পাইনি। যখন পাব তখন কর্মসমিতির সভা ডেকে সিদ্ধান্ত নেব।” তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, সিকিম যাবেন? বাগান-সচিব বললেন, “ফুটবলারদের পেমেন্ট না দিতে পারলে তাদের খেলতে বলব কোন মুখে?” ভবানীপুর ক্লাবের সচিব আবার তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসু। ইডি-সিবিআই, সকলেই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে। সৃঞ্জয়বাবু এ দিন কিছু বলতে চাননি। তবে ক্লাবের পক্ষ থেকে হিসেবরক্ষক বিষ্ণু চক্রবর্তী বললেন, “ইডি যেখানে আমাদের ডাকেইনি, সেখানে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করার কথা আসছে কোথা থেকে?” কালীঘাট ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বাবলু কোলে। যাঁকে সারদা মামলার সূত্রে ইডি আগেই জেরা করেছে। বাবলুবাবু এখন বিদেশে। ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও উত্তর দেননি। তাঁর ক্লাবের অন্য কেউও মুখ খুলতে নারাজ।

তবে এই ক্লাবগুলির এই পরিস্থিতি দেখে রীতিমতো উদ্বিগ্ন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন। ইতিমধ্যেই তাঁরা ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানকে চিঠি দিয়ে হাল-হকিকত জানতে চেয়েছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন, র্যান্টি-শিলটনদের মাইনে বন্ধ হলে কিন্তু দুই ক্লাবেরই লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। তা হলে ফেড কাপ বা আই লিগে খেলতে পারবে না ইস্ট-মোহন।

ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের স্পনসরশিপের যা অবস্থা, তাতে মূল স্পনসর ইউবি দেয় ৭৫% টাকা। বাকি টাকা আসে ক্লাবের অ্যাকাউন্ট থেকে। ইস্টবেঙ্গলকে গত বছর সারদা দিয়েছিল পাঁচ কোটি টাকা। আর সারদা গত ৩ বছরে মোহনবাগানকে দিয়েছে দু’কোটি টাকা। দুই ক্লাবের সচিবই দাবি করছেন, চেকেই টাকা দেওয়া হয়েছে। বাগান সচিব অঞ্জন মিত্র বললেন, “আমরা তো কাঁচা টাকা নিইনি। সব চেকে। হিসেবও দিয়ে দিয়েছি।” আর ইস্টবেঙ্গল সচিব কল্যাণবাবুর দাবি, “কত টাকা পেয়েছি, কত জমা দিয়েছি সবই তো ইডি-কে জানিয়ে দিয়েছি। ওরা টাকা ফেরত দিতে বলছে। আরে টাকা তো আমরা চিডি-সুয়োকাদের পেমেন্ট করে দিয়েছি। সেটা ফেরত দেওয়া সম্ভব নাকি? তা হলে সুদীপ্ত সেন বাজার থেকে যে আলু-পেঁয়াজ কিনেছেন, সেই লোকগুলোর কাছ থেকেও টাকা ফেরত চাওয়া উচিত!” বাগান সচিব অঞ্জনবাবু পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তিনি বললেন, “আমি কিছু বলব না। সময় এলে যা বলার বলব।” র্যান্টি মার্টিন্স, ডুডু, শিল্টন পাল, কাতসুমিরা অবশ্য মন্তব্য করতে চাইছেন না। তাঁদের বক্তব্য, “চুক্তি আছে। খেলব। টাকা নেব। ক্লাবের এ সব ব্যাপারে আমরা কী বলব?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন