দেবকৃপার খোঁজে গিয়ে মিলল কাবুলি ডেরা

ভাঙাচোরা হলদেটে রঙের দোতলা বাড়ি। পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে এসেছে। একতলার ঘরের দরজা বন্ধ। পাশে সদর দরজার চৌকাঠ থেকেই উঠে গিয়েছে খাড়া সিঁড়ি। নীচ থেকে কানে আসছে, ঘসঘস শব্দ! কলকাতা পুলিশের সদর দফতর থেকে শ’দুয়েক মিটারের মধ্যেই পড়ে এই ঠিকানা, ২২ নম্বর ওয়েস্টন স্ট্রিট।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১২
Share:

২২ নম্বর ওয়েস্টন স্ট্রিটের এই বাড়িতেই দেবকৃপা সংস্থার মালিকদের সন্ধানে গিয়ে মিলেছে কাবুলিওয়ালদের ডেরা।—নিজস্ব চিত্র।

ভাঙাচোরা হলদেটে রঙের দোতলা বাড়ি। পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে এসেছে। একতলার ঘরের দরজা বন্ধ। পাশে সদর দরজার চৌকাঠ থেকেই উঠে গিয়েছে খাড়া সিঁড়ি। নীচ থেকে কানে আসছে, ঘসঘস শব্দ!

Advertisement

কলকাতা পুলিশের সদর দফতর থেকে শ’দুয়েক মিটারের মধ্যেই পড়ে এই ঠিকানা, ২২ নম্বর ওয়েস্টন স্ট্রিট। দেবকৃপা ব্যাপার প্রাইভেট লিমিটেড সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা-ডিরেক্টর মণীশ জায়সবাল ও নন্দিতা জায়সবালের বাড়ির নম্বর। অন্তত তেমনটাই নথিভুক্ত হয়েছিল ২০০৬ সালে, কোম্পানি তৈরির সময়। আর, সংস্থার ঠিকানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল সল্টলেকে চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্নর বাড়ির ঠিকানা।

বুধবার আনন্দবাজার হাজির হয় মণীশ-নন্দিতার সেই ‘বাড়ি’তে। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই এক ফালি ছাদ। এক পাশে বসে বিরাট আকারের একটি থালা মাজছেন বড়সড় চেহারার এক কাবুলি যুবক! ঘসঘস শব্দের উৎস সেটাই। মণীশ-নন্দিতার কথা জিজ্ঞাসা করতেই অবাক চোখে তাকালেন। জানালেন, ওখানে কাবুলিওয়ালারাই থাকেন। আর কেউ নয়।

Advertisement

ছাদের লাগোয়া তিনটি ঘর। দু’টি বন্ধ। একটির দরজা সামান্য ফাঁক করা। ভিতরে ঘড়ঘড় শব্দে ফ্যান চলছে। দরজার কড়া ধরে কিছু ক্ষণ ঝাঁকাতে ভিতর থেকে আওয়াজ এল, “অন্দর আইয়ে।” ভিতরে ঢুকতে দেখা গেল, আর এক কাবুলি যুবক মুখে গামছা জড়িয়ে শুয়ে রয়েছেন। মণীশ-নন্দিতার নাম শুনে অবাক হলেন তিনিও। বললেন, ওই নামের কেউ সেখানে থাকেন না।

কস্মিন কালেও কি মণীশ-নন্দিতা ওই বাড়িতে থাকতেন? দুই কাবুলিওয়ালার বক্তব্য, তাঁদের বাপ-ঠাকুর্দারা ইংরেজ আমল থেকে ওই বাড়িতে রয়েছেন। মণীশ বা নন্দিতা নামের কাউকে কোনও দিন ওই বাড়িতে দেখেননি। স্থানীয় এক যুবক বললেন, “আমি জন্ম থেকে এ পাড়ায় রয়েছি। ওই বাড়িতে তো কাবুলিওয়ালারাই থাকেন!” পুলিশ সূত্রেরও বক্তব্য, ওই বাড়িটা কাবুলিদের ডেরা বলেই পরিচিত।

সিবিআই তদন্তকারীরা আগেই জানিয়েছিলেন, দেবকৃপা তৈরি থেকে শুরু করে সারদার হাতে আসা পর্যন্ত, গোটা পর্বটিই খুব স্বচ্ছ নয় বলে তাঁদের ধারণা। খাতায়-কলমে ‘দেবকৃপা’ কেনার আগেই কী ভাবে সংস্থার অফিস শুভাপ্রসন্নবাবুর বাড়ির ঠিকানায় (বিএইচ ১৬৭, সল্টলেক) হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিলই। এ দিন ওয়েস্টন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পরে দ্বিতীয় ঠিকানাটির বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল।

মণীশ ও নন্দিতা ‘দেবকৃপা’ ছেড়ে দেওয়ার পরে শুভাপ্রসন্নবাবু এবং তাঁর স্ত্রী শিপ্রাদেবীর সঙ্গে সংস্থার শেয়ারহোল্ডার হিসেবে ছিল ১২টি সংস্থার নাম ছিল। তার মধ্যে কয়েকটিকে খুঁজতে গিয়েও একই রকমের ঠিকানা বিভ্রাট উঠে এসেছে। এর মধ্যে অ্যালার্ট কনসাল্ট্যান্টস অ্যান্ড ক্রেডিট প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘কুন্দন ব্যাপার প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘আটলান্টিক ভিনট্রেড প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘অরবিট কমোসেল প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে চারটি সংস্থার ঠিকানাই সম্পূর্ণ এক ২২, আর এন মুখার্জি রোড।

ওয়েস্টন স্ট্রিট থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে আর এন মুখার্জি রোডের ওই ঠিকানায় একটি ছ’তলা বাড়ি রয়েছে। প্রতি তলাতেই নানা বেসরকারি সংস্থার অফিস রয়েছে। এ দিন বিকেলে ওই বহুতলে গিয়ে দেখা যায়, এক তলার সিঁড়ির পাশে সাতটি লেটারবক্স। তার একটিতে সাদা কাগজে কালো কালিতে লেখা ‘অ্যালার্ট কনসাল্ট্যান্টস প্রাইভেট লিমিটেড’। কিন্তু গোটা বাড়ি খুঁজেও সেই সংস্থার কোনও হদিস মেলেনি। অন্যান্য সংস্থার কর্মীরাও হদিস দিতে পারেননি। চার তলার একটি সংস্থার এক কর্মী বললেন, “দশ বছর ধরে এই বাড়িতে আসছি। এমন সংস্থার নাম শুনিনি।” তা হলে লেটারবক্সে ওই সংস্থার নাম লেখা কাগজ সাঁটল কে? জবাব দিতে পারেননি কেউই।

দেবকৃপার সংস্থায় শেয়ার ছিল ‘ওমেক্স ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থারও। তার ঠিকানা ৯/১২ লালবাজার স্ট্রিট। ওয়েস্টন স্ট্রিট এবং আর এন মুখার্জি রোড থেকে সামান্য দূরত্বে, লালবাজারের বিপরীতে মার্কেন্টাইল বিল্ডিং। সেই বহুতলের একাংশের ঠিকানা ওই নম্বরটি। কিন্তু মার্কেন্টাইল বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরেও সংস্থাটির হদিস মেলেনি। আশপাশের সংস্থার কর্মীরাও ওই সংস্থার কোনও হদিস দিতে পারেননি।

এতগুলো সংস্থার ঠিকানা না মেলায় স্বাভাবিক ভাবেই এই সংস্থা তৈরি ও তার পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকের ‘রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ’ কি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারে?

এ বিষয়ে কলকাতার রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ-এর এক কর্তার বক্তব্য, সংস্থা নথিবদ্ধ করার সময় তাঁরা ঠিকানা যাচাই করেন না। এ নিয়ে কেউ অভিযোগ দায়ের করলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। “এখন সারদার তদন্তকারী সংস্থা বা অন্য কোনও ব্যক্তি অভিযোগ জানালে বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এ ব্যাপারে শুভাপ্রসন্নর বক্তব্য জানতে শিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছিল। সাড়া মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন