প্রতিবাদ। মুখে কালো কাপড় বেঁধে সাবেক ছিটমহলবাসী। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব
এতটুকু চেহারার আজগার আলির বয়স ১০৩। ঠিক একটা বছর আগে ৩১ জুলাই মধ্য মশালডাঙা ছিটে যখন ভারতভুক্তির উচ্ছ্বাস, আজগারের কুঁচকে যাওয়া মুখ জুড়ে শুধু খিলখিলে খুশি।
আজ সেই বৃদ্ধের মুখ গোঁজ। ঘাড় শক্ত করে জানিয়ে দিয়েছেন— সরকারের দেওয়া বার্ধক্য ভাতা নেবেন না, নেবেন না, নেবেন না।
কেন হে চাচা?
লোকে শুধোলে বলে চলেন— এক বছরে সরকার একটা টাকাও ঢালেনি সাবেক এই বাংলাদেশি ছিটগুলোয়। আজও ইলেকট্রিক আলো চোখে দেখলাম না। আর জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, আপাতত ভাতা দেওয়া হবে ৯০ বছরের বেশি বয়সীদের। আমার চেয়ে অসহায় অনেক মানুষ এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। আমি তাই কিছুতেই টাকা নেব না।
আর এক ছিট পোয়াতুর কুঠির বৃদ্ধ মনসুর শেখের চোয়ালে একটাই দাঁত অবশিষ্ট, আর তিনি স্বাধীনতা দেখেছেন তিন তিনটে। প্রথমে হয়েছিলেন পাকিস্তানি, তার পরে বাংলাদেশি, এখন ‘ইন্ডিয়ান’। এক বছরে তাঁরও মুখের হাসি উধাও। ২০১৫-র ৩১ জুলাই জাতীয় পতাকার রঙের টুপি পরে উৎসবে মাতোয়ারা হয়েছিল এই ছিটেরই বাসিন্দা বিষ্ণু বর্মন, মশালডাঙার জামাল শেখেরা। আজ ঠিক একটা বছর পরে রবিবার তাঁরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদী মিছিলে।
বানের জলে বত্রিগাছ আর ভুরুঙ্গামারি ছিট ডুবে চাষবাস ভেসে গিয়েছে। কেউ কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি, পাবেনও না। কেন? ইন্ডিয়ান হওয়ার বর্যপূর্তি হলেও ছিটবাসীদের জমির মালিকানার দলিল এখনও বাংলাদেশি। প্রশাসন থেকে ব্যাঙ্ক— কেউই সে কাগজ নেয় না। কাজেই মালিকানা প্রমাণের উপায় নেই। সেই কাগজ বদলে নতুন দলিল দেওয়ার কোনও সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এক বছরেও।
ছিটের বাসিন্দাদের প্রায় সকলের জীবিকা চাষাবাদ। বর্ষা শুরু আগে তাঁদের অনেকেই কৃষিঋণের খোঁজে গিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফিরেছেন। বাংলাদেশি দলিল দেখে হাসাহাসি করেছেন সরকারি কর্মীরা। জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা— এটা ভারত, এখানে ও কাগজ চলে না। বানে-খরায় চাষ নষ্ট হলে সরকার ‘ফসল বিমা’ দেয়। সে বিমার সুযোগ নেওয়ারও উপায় নেই। কারণ সেই একই— বাংলাদেশি জমির দলিল গ্রাহ্য নয়।
টিনের বাসায় থাকেন সাবেক ছিটের অধিকাংশ বাসিন্দা। সরকারি ভর্তুকিতে ইটের বাড়ি পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দিনহাটায় গিয়ে ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’র আবেদন করেছিলেন নতুন ভারতীয় হওয়া বেশ কয়েক জন। এসডিও অফিস তাঁদের ডেকে জানিয়ে দিয়েছে, বসত জমির ইন্ডিয়ান দলিল না পেলে ঘরও উঠবে না।
ভারতীয় যে ১১০টি ছিটমহল বাংলাদেশে মিশেছে, সেখানে যে দলিল পরিবর্তনের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে, সে খবর কিন্তু এসেছে মশালডাঙ্গা, বত্রিগাছ বা ভুরুঙ্গামারিতে। তার পরে কোচবিহারে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন জয়নাল, সাদ্দাম, আলমগীরের মতো সাবেক ছিটের বাসিন্দারা। এ পারে তা কবে শুরু হবে, কিছুই বলতে পারেননি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। অথচ শুধু এই জমির ‘ইন্ডিয়ান’ দলিলের জন্যই থমকে আছে সব কিছু। রাস্তা তৈরি হচ্ছে না। স্কুল বা আইসিডিএস-এর জমি বাছা যাচ্ছে না। এমনকী জব কার্ড বিলির পরেও শুরু করা যায়নি ‘১০০ দিনের কাজ’। সেই কার্ড গলায় ঝুলিয়ে জব্বার শেখ বলছেন— এটা ধুয়ে জল খেয়েই আমরা পেট ভরাবো!
এক বছরে সরকারি কাজ বলতে তিনটে কার্ড পেয়েছেন সাবেক ছিটবাসীরা। জব কার্ড, আধার কার্ড আর ভোটার কার্ড। কিন্তু জমির দলিল পরিবর্তন নিয়ে প্রশাসন নীরব। আর সেই মওকায় জমি-হাঙরদের চোখ পড়েছে সাবেক ছিটে। হানাহানির আশঙ্কা বাড়ছে। আর বৃদ্ধ মনসুর-আজগর থেকে নতুন প্রজন্মের বিষ্ণু, সাদ্দাম, জামালরা ভাবছেন— এ কেমন স্বাধীনতা, যার জন্য ৬৯ বছর হাপিত্যেশ করে ছিলেন ছিটের মানুষ!