স্বাদ, স্মৃতি, সত্তা নিয়ে শহরে মায়া-কন্যা

এউদা দীর্ঘদিন গুয়াতেমালার সংস্কৃতি মন্ত্রকের রাষ্ট্রদূত। শুনে ঠাকুরবাড়ির মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরীদেবী বা লীলা মজুমদারদের কথা মনে পড়ল। বাঙালির খাদ্যপ্রণালী, মেনু, তার ঐতিহাসিক ভিত্তি মেলে ধরতে প্রজ্ঞার প্রজ্ঞা দুর্লভ।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:০৪
Share:

এউদা মোরালেস

নিজেকে নারীবাদী বলেন তিনি। এবং হেঁশেলেই মুক্তির পথ খুঁজছেন!

Advertisement

এ গ্রহের অপর প্রান্তে গুয়াতেমালা সিটির মিশুকে মহিলার সঙ্গে চ্যাটে কথা হচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষ্টিবিদ্যার পণ্ডিত এউদা মোরালেস। গুয়াতেমালার রন্ধন-সংস্কৃতির ইতিহাসকার লেখক, সাংবাদিকও। ‘‘স্বাদ মানে তো শুধু মশলাপাতি বা রান্নার প্রণালী নয়। শৈশবের ঘরোয়া ভোজ-আসরই আমার কাছে প্রথম সংস্কৃতি বা ইতিহাস-পাঠের ইস্কুল।’’ বইমেলার উদ্বোধনী আসর এবং অশোককুমার সরকার স্মৃতি বক্তৃতায় তাঁর দেখা মিলছে।

এউদা দীর্ঘদিন গুয়াতেমালার সংস্কৃতি মন্ত্রকের রাষ্ট্রদূত। শুনে ঠাকুরবাড়ির মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরীদেবী বা লীলা মজুমদারদের কথা মনে পড়ল। বাঙালির খাদ্যপ্রণালী, মেনু, তার ঐতিহাসিক ভিত্তি মেলে ধরতে প্রজ্ঞার প্রজ্ঞা দুর্লভ। লীলা মজুমদারের ‘রান্নার বই’য়েও নাগরিক-হেঁশেলের রোজনামচার দলিল। দমপোক্ত শৈলীর রন্ধন-পরম্পরার ধারক-বাহক ইমতিয়াজ় কুরেশি ‘পদ্মশ্রী’ পেয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্মান বা মেধার স্বীকৃতিতে হেঁশেল কিংবা হেঁশেল ঘিরে ইতিহাস চর্চার ব্যক্তিত্বদের সচরাচর আমাদের মনে পড়ে না।

Advertisement

এউদার রান্নার গল্পের বই ‘ট্রেজার্স, কালিনারি স্টোরিজ়’-এ রক্তে টান দিচ্ছেন অখ্যাত দিদিমার দিদিমারা। যার শিকড় মায়া সভ্যতাকে ছুঁয়েছে। গুয়াতেমালার নোবেলজয়ী সাহিত্যিক মিগুয়েল আস্তুরিয়াস মায়া পুরাণ-ইতিহাসে রসদ খুঁজেছেন। গল্পের খোঁজে এউদাও আদিম জনজাতির রানিদের দোরে হাত পেতেছেন। এউদা বলছিলেন, ‘‘স্প্যানিশ উপনিবেশ-উত্তর গুয়াতেমালাতেও ২২টি মায়া ভাষা বহমান। মায়া ধর্মগ্রন্থ বলছে, আদিম দেবতারা হলুদ ও সাদা ভুট্টাদানার মিশেলেই মানুষের সৃষ্টি করেন। মধ্য আমেরিকা বা মেসোআমেরিকান খাদ্য ঘরানা আজও সেই যুগের স্মরণে জাতিস্মর।’’ ভুট্টা, রাজমা বিশেষ, কুমড়ো, আলু বা চকলেটের উৎপাদক কাকাও, লঙ্কা গুয়াতেমালার ইতিহাসের ভোরেও ছিল। বিশ্বায়নের প্রভাবে কিছু বদল এসেছে। তবু এউদার মতে, রান্নার খুঁটিনাটিতেই গুয়াতেমালার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের স্বাক্ষর।

ইউরোপীয় শৈলীতে সস ও মাংস আলাদা প্রস্তুত করা হয়। গুয়াতেমালায় খানিকটা আমাদের মতো মাছ-মাংস-আনাজ ঝোলের সঙ্গে ফুটিয়ে রান্নাই দস্তুর। কলাপাতা, ভুট্টার খোসায় ভাপানো ‘তামালেস’ একান্তই বাঙালি পাতুরির জাতভাই। ভোজ-রীতির গল্পেই দেশে-দেশে গুয়াতেমালার সংস্কৃতি মেলে ধরেন তিন তরুণ সন্তানের মা এউদা।

কিন্তু রান্না নিয়ে এই বাড়াবাড়ি তো মেয়েদের সাবেক ভাবমূর্তিটাই দাগিয়ে দিচ্ছে! রান্নার ঝক্কি কি মেয়েদের বৌদ্ধিক-চর্চার পরিসরটা খাটো করে দেয় না? এউদার জবাব: রান্নাঘর মেয়েদের উত্তরণের পথে বাধা নয়। জ্ঞান, সৃষ্টিশীলতা, উদ্ভাবনী প্রয়োগ সবই লাগে রান্নায়।’’ গুয়াতেমালায় সাবেক রান্নাঘরের ছবিটাও পাল্টাচ্ছে বলে দাবি এউদার। ‘‘হেঁশেল মোটেও মেয়েদের জেলখানা নয়। রান্না এখন একটা পারিবারিক কাজ। যৌথতার উদ্‌যাপনে রান্নাও নানা রকমের হচ্ছে।’’ মেয়ে-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী বলেই নিজেকে নারীবাদী বলেন এউদা।

কলকাতার মাছের ঝোলের জন্য এখন অপেক্ষায় মায়া-সভ্যতার মেয়ে। মাছ ছাড়া আমিষ পারতপক্ষে খান না তিনি। তবে রান্নার হাঁড়িতে রাজনীতি না-পসন্দ তাঁর। ‘‘খানা আপরুচি! সবার পছন্দকেই সম্মান করা উচিত।’’— ভারতে আসার আগে এটাও বললেন এউদা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন