হ্যালো সিবিআই? পাড়ায় ঝামেলা, দেখুন না

ভরদুপুরে ফোন বেজে উঠল। তুলতেই ও-পার থেকে ভেসে এল আকুল আর্তি— ‘‘হ্যালো, সিবিআই? বাঁকুড়া থেকে বলছি। আমার ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটু দেখুন না স্যার!’’ বক্তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফোন নামাতে না-নামাতেই ফের ক্রিং ক্রিং। এ বার মালদহ থেকে। জনৈক গ্রামবাসী তাঁদের পঞ্চায়েতে দুর্নীতির তদন্ত চাইছেন!

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৫ ০৩:২৯
Share:

সিবিআইয়ের পোস্টার। হাওড়া স্টেশনে টিকিট কাউন্টারের দেওয়ালে। দেবস্মিতা ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

ভরদুপুরে ফোন বেজে উঠল। তুলতেই ও-পার থেকে ভেসে এল আকুল আর্তি— ‘‘হ্যালো, সিবিআই? বাঁকুড়া থেকে বলছি। আমার ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটু দেখুন না স্যার!’’

Advertisement

বক্তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফোন নামাতে না-নামাতেই ফের ক্রিং ক্রিং। এ বার মালদহ থেকে। জনৈক গ্রামবাসী তাঁদের পঞ্চায়েতে দুর্নীতির তদন্ত চাইছেন!

অহরহ এমন সব ফোনে ইদানীং ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে সিবিআইয়ের দুর্নীতিদমন শাখা। এমনকী, পাড়ার স্কুলে শিক্ষকের নিয়মিত গরহাজিরার অভিযোগ নিয়েও ফোন যাচ্ছে নিজাম প্যালেসের চোদ্দোতলায় সিবিআই অফিসে। ব্যাপারটা কী?

Advertisement

কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর খবর: দুর্নীতি মোকাবিলায় আমজনতার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার লক্ষ্যে ফোন নম্বর উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। তাতে বলা ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারি বা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ কোনও প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী-অফিসারদের দুর্নীতি সম্পর্কে সিবিআইয়ে অভিযোগ জানানো যাবে। সে সব নিয়ে ফোন তো আসছেই। সঙ্গে জুড়েছে এলাকার নানা ঝামেলা-গণ্ডগোল কিংবা রাজ্য সরকারি সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসনের দুর্নীতি সংক্রান্ত নালিশও, যেগুলো দেখার দায়িত্ব রাজ্য পুলিশের।

কেন্দ্রীয় ব্যুরোর একাংশ মনে করছে, সিবিআইয়ের দুর্নীতিদমন শাখা ঠিক কাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে, সে ব্যাপারে অনেকের স্পষ্ট ধারণা না-থাকার ফলেই এমনটি ঘটছে। আবার অনেকের পর্যবেক্ষণ, ছোটখাটো ঘটনাতেও সিবিআই’কে ফোন করাটা রাজ্য পুলিশ ও প্রশাসনের উপরে আস্থা হারানোরই ইঙ্গিত। এই মহলের মতে, জনমানসে ধারণা তৈরি হয়ছে যে, স্থানীয় থানা বা প্রশাসনের কাছে দৌড়ে শুধু পণ্ডশ্রমই হবে, অন্যায়ের প্রতিকার কিছু হবে না।

পরিণামে দিন-রাত ফোনের ঢল সিবিআই অফিসে। শুধু যে উল্টোপাল্টা ফোন, তা নয়। অনেক সময়ে কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির খবরও আসছে। ব্যুরোর এক অফিসার জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এমন কিছু ফোন তাঁরা পেয়েছেন, যার ভিত্তিতে খোঁজ-খবর করতে গিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতি-চক্রের হদিস মিলেছে। সে সবের ভিত্তিতে ধরপাকড়ও হয়েছে।

বস্তুত মালদহ-পুরুলিয়ার মতো একাধিক জেলায় এই জাতীয় দৃষ্টান্ত রয়েছে বলে সিবিআই-সূত্রের দাবি। ‘‘কিছু ক্ষেত্রে আমাদের অফিসারেরা গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেছেন। তার ভিত্তিতে অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসারকে হাতে-নাতে ধরা হয়েছে।’’— বলছেন সূত্রটি। তাঁর ব্যাখ্যা: প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কলকাতায় এসে সিবিআইয়ে অভিযোগ দায়ের করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই এ ধরনের ফোন নম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে। তা ছাড়া এতে অভিযোগকারী চাইলে পরিচয় গোপন রাখতে পারেন।

তাই দূরভাষে খবর দেওয়ার পদ্ধতি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। যদিও প্রয়োজনীয় ফোনের পাশাপাশি অন্য ধরনের নানা ফোন ধরতে ধরতে নিত্য জেরবার হয়ে পড়ছেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা। সমস্যা সম্পর্কে তাঁরা উঁচুতলাকে অবহিত করেছেন। আর তার পরেই স্থির হয়েছে, ব্যাপারটা নিয়ে ফের নতুন ভাবে প্রচারে নামবে সিবিআই। কী ভাবে?

ব্যুরোর এক কর্তা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনের নির্দেশিকা মেনে বিভিন্ন সরকারি অফিস, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার অফিসের গায়ে ছোট-বড় পোস্টার লাগানো হবে। সিবিআইয়ের কলকাতা আঞ্চলিক দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘মানুষের যাতে চোখে পড়ে, সে ভাবেই পোস্টারগুলো লাগানো হবে। খবরের কাগজেও বিজ্ঞাপন বেরোবে।’’

সিবিআইয়ের বক্তব্য: সম্প্রতি দেশ জুড়ে দুর্নীতির দমনের কাজে আরও গতি আনার নির্দেশ এসেছে। তাই ঠিক কী কী ক্ষেত্রে সিবিআইয়ের দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা হবে। উদাহরণও দিয়েছেন সিবিআইয়ের এক কর্তা— ‘‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কিছু অসাধু অফিসার ঋণ দেওয়ার সময় কমিশন দাবি করেন। ফলে বহু লোক হেনস্থার শিকার হন। এ নিয়ে অভিযোগ জানালে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ এই সব তথ্য প্রচারের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে নাগরিকদের মোবাইলে মোবাইলে এসএমএস পাঠানোও শুরু হয়েছে।

কিন্তু গেরো সেখানেও!

পেশায় রাজমিস্ত্রি এক যুবক সম্প্রতি নিজাম প্যালেসে ফোন করেছিলেন। এক সিবিআই অফিসার ফোন ধরতেই তাঁর সোজা-সাপ্টা প্রশ্ন, আপনারা আমায় মেসেজ পাঠালেন কেন?

‘‘সার্বিক সচেতনতা না-বাড়লে এমন সমস্যার সুরাহা হবে না।’— মন্তব্য এক ব্যুরো কর্তার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন