একসঙ্গে: ইসলামপুরের নসিয়তপাড়ায় প্রথম সরস্বতী পুজো। ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম
অঞ্জলি দেবেন বলে কাকভোরে ভৈরবে ডুব দিয়ে এসে কাঁপছেন হামিদুল। নাজমুল ছুটলেন ফলের বাজারে। সাহাবুদ্দিন চললেন পুরোহিতকে ডাকতে।
প্যাডেলে চাপ দিয়ে সাহাবুদ্দিন বলছেন, ‘‘কচিকাঁচারা উপোস করে আছে। তা ছাড়া পুজোটাও তো সময়ে শেষ করতে হবে, নাকি!’’
মুর্শিদাবাদে ভৈরবের পাড়ে ইসলামপুরের নসিয়তপাড়া। ক’দিন ধরেই সেখানে হইহই কাণ্ড। গ্রামে যে এই প্রথম পুজো হচ্ছে! সরস্বতী পুজো।
ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই গোটা গ্রাম যেন নাওয়া-খাওয়া ভুলেছে। ধীমান দাস আগেই বলে রেখেছিলেন, ‘‘প্রয়োজনে সারা রাত জেগে থাকব। কিন্তু প্যান্ডেল যেন নজরকাড়া হয়! ’’
শরিফুল ইসলাম আশ্বস্ত করেছেন, ‘‘ও নিয়ে ভেব না। তোমাদের চাচির পাট না ভাঙা বহু শাড়ি রয়েছে। বাড়ি থেকে নিয়ে এসো।’’
আলো সরকার বলেছেন, ‘‘আমি কিন্তু দারুণ ফল কাটতে পারি। আর কলাগাছের দায়িত্বও আমার!’’ অতএব, রাখে সরস্বতী, রোখে কে!
তামাম গাঁয়ে ছ’শোটি পরিবারের বাস। তার মধ্যে সাকুল্যে চার ঘর হিন্দু। পুজো-পার্বণে ওই চারটি পরিবার চলে যায় অন্য গ্রামে, আত্মীয়ের বাড়ি। ষষ্ঠী ভাস্কর বলছেন, ‘‘এই প্রথম বার সরস্বতী পুজোয় সকলেই গ্রামে আছেন।’’
স্থানীয় একটি ক্লাবের সম্পাদক হামিদুল শেখের সঙ্গে প্রতিদিনই আড্ডা দেন নাজমুল, আলো, ষষ্ঠীরা। প্রথম কথাটা পাড়েন হামিদুল, ‘‘আমাদের নসিয়তপাড়া ছাড়া সব গ্রাম এই সময় আনন্দে মেতে ওঠে। আচ্ছা, সরস্বতী পুজো করলে কেমন হয়?’’ এক কথায় রাজি বাকিরা। কিন্তু সেই সঙ্গে ছিটকে এসেছিল প্রশ্নটাও—‘‘পুজোর খরচ, ঝক্কি সামলাবে কে?’’ শাহরুখ খানের কায়দায় মুচকি হেসেছিলেন হামিদুল, ‘‘ম্যায় হুঁ না!’’
বেবি লিগের সংগঠক, পরিচিত ফুটবলার হামিদুলের এলেম নিয়ে কারও কোনও সংশয় নেই। কিন্তু তাই বলে পুজো?
যুক্তিটা যেন হামিদুলের ঠোঁটেই ঝুলছিল, ‘‘দুর্গাপুজোর খরচ অনেক। সামাল দেওয়া কঠিন। কিন্তু সরস্বতী পুজোটা অনায়াসেই করা যায়। তা ছাড়া স্কুলে পুজো করার অভিজ্ঞতা তো আছেই। দেখিস, হয়ে যাবে!’’
হলও তাই। হাঁজার পাঁচেক টাকা বাজেটের মধ্যেই রবিবার সকালে নিখুঁত ও নিপুণ ভাবে পুজোর যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন হামিদুল ও তাঁর টিমের সদস্যেরা।
গ্রামের আশারানি ভাস্কর বলছেন, ‘‘সেই বিয়ের পর থেকে এই এত বছরে গ্রামে কোনও পুজো দেখিনি। এই প্রথম গ্রামে থেকেই সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিলাম।’’
ভালয় ভালয় সব মিটে যাওয়ায় স্বস্তির হাসি হামিদুলের মুখে। তিনি বলছেন, ‘‘উৎসব উৎসবই। বিদ্যার আবার আলাদা করে কোনও জাত-ধর্ম হয় নাকি!’’
ঝুপ করে নেমে আসে মাঘের সাঁঝ। ভৈরবের পাড় দিয়ে ছুটতে ছুটতে কচিকাঁচারা আওড়ে চলে, ‘‘আসছে বছর, আবার হবে!’’