State News

‘পুলিশ গাড়ির ভিতর থেকে গুলি চালিয়েছে’

যে দাড়িভিট হাইস্কুলের সামনে গত সপ্তাহে ভয়ানক ঘটনাটা ঘটেছিল, সেই চত্বরটা তো একেবারে নিঝুম পুরী। স্কুলটাকে বাঁ হাতে রেখে কিছুটা এগোতেই পাকা রাস্তার ধারে বাড়িটা গোবিন্দ সরকারের।

Advertisement

সোমনাথ মণ্ডল

ইসলামপুর শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২০:০৫
Share:

মাথার কাছে বাবা গোবিন্দ সরকার। বাড়িতে বিপ্লব। মঙ্গলবার দাড়িভিটে তোলা নিজস্ব চিত্র।

বিকেলবেলা যখন দাড়িভিট পৌঁছলাম, গোটা গঞ্জটাই কেমন যেন শুনশান। দোকানপাট বেশির ভাগই বন্ধ। যে ক’টা খোলা রয়েছে, তার অধিকাংশই মাছি তাড়াচ্ছে। লোকজন কিছুই নেই।

Advertisement

যে দাড়িভিট হাইস্কুলের সামনে গত সপ্তাহে ভয়ানক ঘটনাটা ঘটেছিল, সেই চত্বরটা তো একেবারে নিঝুম পুরী। স্কুলটাকে বাঁ হাতে রেখে কিছুটা এগোতেই পাকা রাস্তার ধারে বাড়িটা গোবিন্দ সরকারের। পিছন দিকে সবুজ চা-বাগান। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, বাড়িতে কেউ আছে! আজই ছেলেটাকে নিয়ে আসা হয়েছে। অথচ, কিছু ক্ষণের মধ্যেই তাকে ফের অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হবে। কোথায়? বলতে চাইলেন না কেউই।

বেড়ার ঘর। টিমটিম করে আলো জ্বলছে। খাটেশুয়ে রয়েছে নস্যি রঙের হাফ-প্যান্ট পরা খালি গায়ের এক কিশোর। বাঁ পায়ের হাঁটুর ঠিক উপরে মোটা করে ব্যান্ডেজ বাঁধা। যন্ত্রণায় ছটফট করছে বছর পনেরোর ছেলেটি। পায়ে গুলি লেগেছে যে! ঘরে ঢুকতেইঅচেনা মুখ দেখে প্রথমে চমকে গিয়েছিল। পুলিশ নয় তো! পরিচয় দিতেই আবেগ চেপে রাখতে না পেরে বলে উঠল, “আমার চোখের সামনে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। আমি দেখেছি। গাড়ির ভিতর থেকে পুলিশ গুলি চালিয়েছে।”

Advertisement

উত্তর দিনাজপুরের দাড়িভিটে গত বৃহস্পতিবার গোলমালের সময়ে পায়ে গুলি লেগেছিল বিপ্লব সরকারের। যে দাড়িভিট হাইস্কুলকে নিয়ে এত গন্ডগোল, বিপ্লব সেই স্কুলেরই ছাত্র। চোখের সামনে বন্ধু রাজেশ সরকারের মৃত্যু দেখেছে সে। নিজেও এখনও বিপন্মুক্ত নয়। পুলিশের ভয়ে তার পরিবার সরকারি হাসপাতাল থেকে নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়েছিল। কিন্তু, সেখানেও নাকি বিপদ ‘ওত পেতে’ ছিল। তাই নার্সিংহোম থেকে ‘বন্ড’ সই করে বিপ্লবকে বার করে আনা হয়েছে আজ। পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে তাকে অন্যত্র রাখার বন্দবস্ত করা হচ্ছে।পরিবারের আশঙ্কা, বিপ্লবকে নাগালে পেলে পুলিশ হেনস্থা করতে পারে। জোর করে সই করিয়ে নেওয়া হতে পারেসাদা কাগজে।

বিপ্লব কী বললেন, দেখে নিন ভিডিয়োয়

কেন এমন ভাবছেন? চাষবাস করেন বিপ্লবের বাবা গোবিন্দবাবু। তিনি বললেন, “আমার ছেলে এখনও বলছে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। আর পুলিশ বলছে আমরা গুলি চালাইনি। ছেলেকে হাতে পেলে ওরা কি ছেড়ে দেবে? ইসলামপুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল ওকে। চিকিৎসা হচ্ছিল না। তা সত্ত্বেও জোর করে আটকে রাখা হচ্ছিল। কোনও রকমে ওখান থেকে বার করে শিলিগুড়ির এক নার্সিংহোমে ভর্তি করাই। তার পরেও রেহাই নেই।”

আরও পড়ুন- ‘বদলা আমরা নেবই’, হেমতাবাদের জনসভা থেকে পুলিশকে হুমকি দিলীপের​

আরও পড়ুন- পুলিশকে গাছে বেঁধে মারুন, হুমকি দিয়ে ধৃত বিজেপি নেতা​

অন্ধকার ঘরেই শুয়েছিল বিপ্লব। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছিল সে দিন? যন্ত্রণার মধ্যে যেন চেপে রাখা ক্ষোভ উগরে দিল। তাঁর কথায়: “ওই দিন পুলিশ মাঠের মধ্যে গাড়ি নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎ গাড়ির ভিতর থেকেই গুলি চালায়। রাজেশের গায়ে গুলি লাগে। একটা গুলি এসে আমার পায়েও লাগে। এই অবস্থায় পুলিশ আমাদের সাহায্য তো করেইনি। উল্টে ধড়পাকড় শুরু করে। আমাকে আর রাজেশকে একটি ম্যাজিক ভ্যানে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। হঠাৎ রাস্তার মাঝে একদল যুবক গাড়ি আটকায়। তার পর ওই অবস্থাতেই মারধর করতে শুরু করে। আমাদের দু’জনকে রেখে পালিয়ে যায় সকলে। একজনের মাথা ফেটে গিয়েছিল। ওই অবস্থাতেই আধ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে গাড়িতেই পড়েছিলাম। তখন যদি পুলিশ আমাদের সাহায্য করতে তাহলে হয়তো রাজেশও বেঁচে যেত।”

বিপ্লব ফুটবল খেলতে ভালবাসে। হঠাৎ একটি ঘটনা যেন সব এলোমেলো করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে ছেলে আর বলে পা দিতে পারবে কি না, আক্ষেপ সরস্বতীদেবীর। বিপ্লবের মায়ের একটাই প্রশ্ন, ‘‘আমার ছেলেটার কী দোষ ছিল বলুন তো! দোষীদের কী শাস্তি হবে না?’’

বিপ্লবের বাবা বলছিলেন, পাঁচটা বাজতে না বাজতেই গ্রামটা পুরুষশূন্য হয়ে যায়। পুলিশের ভয়ে। এমনকি, দোলঞ্চা নদীর ধারে পুঁতে রাখা গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত দুই ছাত্র রাজেশ সরকার এবং তাপস বর্মণের দেহ পাহারা দেওয়ার মতো লোকও পাওয়া যাচ্ছে না।আর কেউ কোনও কথা বলতে চাইলেন না। বিপ্লবের বাড়ি থেকে যখন বেরোচ্ছি, তখন সন্ধে নেমে এসেছে দাড়িভিটে। রাস্তায় একটাও লোক নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন