‘লিঙ্ক ফেল’, মূল স্রোতে ফিরছে কালিয়াচক

পাঁচশো, হাজার নয়। এখন নজর একশো, তিনশোর দিকে। মালদহের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রামে-গ্রামে এখন এমনই বার্তা ঝড়ের গতিতে রটে গিয়েছে। পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট বাতিল বলে ঘোষণার পরেই এই বার্তা পৌঁছেছিল সীমান্ত ছুঁয়ে থাকা কালিয়াচকের মহব্বতগঞ্জে।

Advertisement

অভিজিৎ সাহা ও জয়ন্ত সেন

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৫
Share:

পাঁচশো, হাজার নয়। এখন নজর একশো, তিনশোর দিকে।

Advertisement

মালদহের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রামে-গ্রামে এখন এমনই বার্তা ঝড়ের গতিতে রটে গিয়েছে। পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট বাতিল বলে ঘোষণার পরেই এই বার্তা পৌঁছেছিল সীমান্ত ছুঁয়ে থাকা কালিয়াচকের মহব্বতগঞ্জে। সেখান থেকে গোলাপগঞ্জ, চৌরি অনন্তপুর, দুইশত বিঘি, মিলিক সুলতানপুর হয়ে মোজমপুর পর্যন্ত ঘরে-ঘরে একই আলোচনা। একই ফিসফাস।

কিন্তু কথাটার মানে কী?

Advertisement

বৃহস্পতিবার দুপুরে মহব্বতপুরের ভিডিও মোড়ের দিকে মেঠো রাস্তার ধারে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে নূর মহম্মদ, মানিক মণ্ডল (আসল নাম নয়) বললেন, ‘‘এটা তো জলের মতো সোজা। পাঁচশো, হাজার টাকার নোট তো বাতিল। তাই ওই দু’টো সংখ্যার মানে তো বোঝাই যাচ্ছে। আর আমাদের নজর এখন একশো দিনের কাজ, বা বাইরে গিয়ে কাজ করলে তিনশো টাকার দিনমজুরির দিকে।’’ তারপরে তাঁরা হেসে জানালেন, ‘‘যাঁদের হয়ে এত দিন ধরে কাজ করছি, তাঁরাই এ কথা জানিয়ে দিয়েছেন।’’

সেই তাঁরা কোথায় থাকেন? উত্তরে গলগল করে বিড়ির ধোঁয়া উড়তে থাকে। আঙুল তুলে একজন যে দিকে দেখিয়ে দেন, সে দিকে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের ঘরদোর। ইতিমধ্যে ভ্যানো (মোটর চালিত ভ্যান) থেমেছে দোকানের সামনে। এক সঙ্গে ৭ জন পুরুষ-মহিলা নেমে সোজা দোকানের সামনে জটলায়। মানিক, নূরকে ঘিরেই ‘আলোচনা’ শুরু। যোগ দিলেন ভ্যানো চালকও। নিচু স্বরে আলোচনার মধ্যে টুকরো-টুকরা যা কানে পৌঁছল, তা হচ্ছে, ‘‘না, এখন সব বন্ধ। আবার কবে হবে জানি না। ফোন বন্ধ। ও পাড়ের লিঙ্ক ফেল করছে।’’

‘লিঙ্ক ফেল’ শুনেই সব চুপ। ফের কথাবার্তা শোনা গেল—‘না, না, কোনও ভাবে ব্যাঙ্কে কিছু টাকা ঢুকিয়ে দিতেই হবে। বড়রা মিলে ১০০ দিনের কাজে ঢুকে পড়।’’ কিন্তু, যেখানে দিনে জাল নোট পাচার করে ২-৩ হাজার টাকা আয় হত, সেখানে ১০০ দিনের কাজ করলে মাসে মাত্র দেড়শো টাকা পেলে কী করে চলবে?

দুই মাতব্বরের অবশ্য পরামর্শ, ‘‘থানা-পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি শেষ। ঘুষ দিতে হবে না আর। ক’দিন এ ভাবে বেঁচে দেখ না, কেমন লাগে!’’ জটলার ৩ জন রাজি হন তো ৪ জন গররাজি। তাঁরা ভিন রাজ্যে কাজে চলে যাবেন বলে পণ করেছেন। সেখানে গেলেই দৈনিক তিনশো টাকা মিলবে যে! প্রায় ঘণ্টাখানেক ‘আলোচনা’র পরে ভ্যানো মুখ ঘুরিয়ে ধুলো উড়িয়ে ফিরে গেল কালিয়াচক শহরের দিকে।

এমন ‘আলোচনা’ যে কালিয়াচকের গাঁ-গঞ্জে মঙ্গলবার রাত থেকে হচ্ছে, তা বিলক্ষণ টের পাচ্ছে পুলিশ-প্রশাসন-পঞ্চায়েতও। পুলিশ সূত্রে খবর, ওই এলাকার গ্রামগুলির অন্তত দেড়শো জন জাল নোট পাচারের অভিযোগে দেশের নানা জেলে বন্দি। জাল নোট পাচার করলে মোটা ‘পারিশ্রমিক’। এই কাজে এই অঞ্চলের বেশ কয়েকজন যুক্ত বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। তাঁরাই এখন বেকায়দায়। এ সব নজরে রয়েছে পুলিশ, বিএসএফেরও। মালদহের পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, ‘‘সব কিছুই নজরে রাখা হচ্ছে।’’

গোলাপগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান নাসিমা বিবিও বলেন, ‘‘একশো দিনের প্রকল্পে গতি আনার চেষ্টা হচ্ছে। যে কেউই আবেদন করলে সঙ্গে সঙ্গেই যাতে কাজ পায়, সেটা দেখা হবে। তবে জাল নোটের কারবারিদের শাস্তিও দেওয়া দরকার।’’

কালিয়চক ৩ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সরিয়াতুল ইসলামের কথায়, ‘‘জাল নোটের কারবার চলে বলে ব্লকেরই একটা বদনাম রয়েছে। তবে পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বাতিল করায় সেই বদনাম এ বার ঘুচবে।’’

ভিন রাজ্যে শ্রমিক সরবরাহের ঠিকাদার রমেন মণ্ডল, মুস্তাক আমেদ জানান, বুধবার থেকে তাঁদের কাছে নাম লেখাতে এমন অন্তত ২০০ জন গিয়েছেন, যাঁরা এত দিন দৈনিক গড়ে ২-৩ হাজার টাকা আয় করতেন। বাড়িতে দামি টিভি, মোবাইল, বাইক সবই আছে তাঁদের। এর পরেই তাঁরা জানান, জাল নোটের কারবার যে আপাতত আর হওয়ার নয়, সেটা বুঝেছে কালিয়াচকের অনেকেই।

ঘটনা হল, শুধু বৃহস্পতিবারই কালিয়াচকের একটি ব্যাঙ্কে রাত পর্যন্ত ১ কোটি টাকা (পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট) জমা পড়েছে। বাকি ব্যাঙ্কের হিসেব রাত পর্যন্ত জানা যায়নি। ওই ব্যাঙ্কের সামনেই দেখা গেল জাল নোটের কারবারি সন্দেহে অতীতে ধৃত এক ব্যবসায়ীকে। তিনি নাম না প্রকাশের শর্তে অনেক কথাই জানিয়ে দিলেন। তা হল, এক লক্ষ টাকার জাল নোট কিনতে দরকার হত ভারতীয় ৩৫ হাজার টাকা। সেই টাকা ভিন রাজ্যে বিক্রি করলে দাম মিলত ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। জাল নোট কেনার জন্য এখনও এলাকার একজনের বাড়িতে ৭ লক্ষ ভারতীয় টাকা (পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট) মজুত রয়েছে। এখন সেই টাকা কী হবে?

ওই ব্যবসায়ী বাইকে বসে নিজের চুল নিজেই খিমচে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন মোজমপুরের দিকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement