অসহায়: জান্নাতুন ফিরদৌসি। —নিজস্ব চিত্র।
জড় পদার্থের মতো শুয়ে রয়েছেন বছর কুড়ির তরুণী।অবস্থা সঙ্কটজনক। জলপাইগুড়ির বীরপাড়া হাসপাতালের শয্যাই আপাতত তাঁর ঠিকানা। প্রাণে বেঁচে গেলেও ফিরতে পারবেন না স্বাভাবিক জীবনে।
সেই মেয়ে জান্নাতুন ফিরদৌসির জন্য এ রাজ্যের অনেক দরজায় কড়া নেড়ে ব্যর্থ হয়েছেন বাবা আমজাদ আলি। এ বার দার্জিলিঙের লিগাল এড ফোরামের মাধ্যমে আবেদন করলেন দেশের শীর্ষ আদালত সুপ্রিম কোর্টে। সেখানকার যে আইনজীবী আবেদনটি পয়লা এপ্রিল জমা দিয়েছেন, সেই অনীশ রায় জানিয়েছেন, শীর্ষ আদালতে আবেদন গৃহীত হয়েছে। নথিপত্র খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে।
লিগাল এড ফোরামের সম্পাদক অমিত সরকার দাবি করেছেন, ২০১৩ সালে ‘শিশুসাথী’ প্রকল্প চালু হওয়ার সময়ে রাজ্য সরকারের তরফে হাসপাতালের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে কলকাতার এসএসকেএম ও দুই বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়াও ছিল দুর্গাপুরের একটি হাসপাতালের নাম। শিলিগুড়ির চ্যাং হাসপাতালের নাম তাতে ছিল না। অথচ, ওই চ্যাং হাসপাতালে রাজ্য সরকারের ‘শিশুসাথী প্রকল্প’-এর অধীনে চিকিৎসার সময়ে মারা গিয়েছে বেশ কিছু শিশু। অভিযোগ, জান্নাতুনের আজকের এই অবস্থার জন্যও ওই হাসপাতালই দায়ী। সুপ্রিম কোর্টের আবেদনে এই সমস্ত অভিযোগও করা হয়েছে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘চ্যাং পরে আবেদন করে শিশুসাথী প্রকল্পে চিকিৎসার কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু জান্নাতুন-সহ বেশ কয়েক জনের ব্যাপারে খবর পেয়ে আমাদের চিকিৎসকেরা সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। তার পরে শিশুসাথী প্রকল্প থেকে চ্যাং হাসপাতালের নাম বাদ দেওয়া হয়।’’
২০১৫ সালে আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট ব্লকের রাঙালিবাজনা গ্রামে নবম শ্রেণিতে পড়ত কিশোরী জান্নাতুন। জুলাই মাসের এক দিন তাদের মাদ্রাসায় গিয়ে পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার সময়ে জান্নাতুনের হৃদ্যন্ত্রে সমস্যা পাওয়া যায়। ওই কিশোরীকে তখন নিয়ে যাওয়া হয় শিলিগুড়ির চ্যাং হাসপাতালে। বলা হয়, হৃদ্যন্ত্রে অস্ত্রোপচার করতে হবে।
দরিদ্র পরিবারের ১৬ বছরের কম বয়সি কারও হৃদ্যন্ত্রে অস্ত্রোপচার করার জন্য রাজ্য সরকারের ‘শিশুসাথী’ প্রকল্প চালু হয়েছিল তারও বছর দুই আগে। সে বছরের ২৭ জুলাই সেই অস্ত্রোপচারের পরে কোমায় চলে যায় কিশোরী জান্নাতুন। প্রথম দু’মাস জ্ঞানই ফেরেনি তার। জানা যায়, হৃদ্যন্ত্রে অস্ত্রোপচারের সময়ে তাঁর মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোমরের নীচের অংশ অসাড় হয়ে যায় জান্নাতুনের। কথাবার্তা হয়ে যায় অসংলগ্ন। ওই অবস্থায় এক দিন বাড়ি আনা হলেও সেখানে রাখা যায়নি। পরের দিনই নিয়ে যেতে হয় হাসপাতালে। অভিযোগ, তার পর থেকে কার্যত ওই ভাবেই হাসপাতালে শয্যায় পড়ে রয়েছে মেয়েটি।
জান্নাতুনকে সুস্থ করে তুলতে এবং যথাযথ চিকিৎসা পাওয়ার জন্য আমজাদ আলির হয়ে প্রথমে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় ফোরাম। দীর্ঘ আড়াই বছর পরে আদালতের নির্দেশে জান্নাতুনকে দেখতে শিলিগুড়ি যায় এসএসকেএম হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি দল। ঠিক হয়, কলকাতায় এনে প্রয়োজনে মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করতে হবে। ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি এসএসকেএমে ভর্তি করা হয় জান্নাতুনকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে মেডিক্যাল বোর্ড জানায়, তাঁর মস্তিষ্কের ক্ষতি অস্ত্রোপচার করেও ঠিক করা যাবে না। একমাত্র উপায় ওষুধ এবং ফিজ়িয়োথেরাপি।
অমিতবাবু বলেন, ‘‘যে চিকিৎসক এবং হাসপাতালের গাফিলতিতে জান্নাতুনের এই হাল হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে নতুন করে অভিযোগ জানানো হচ্ছে।’’ সেই মতো আবার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। আমজাদ আলির কথায়, ‘‘মেয়েকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে পেতে চাই। যাঁরা আমার মেয়ের এই সর্বনাশ করেছেন, তাঁদের শাস্তি চাই।
আর কখনও কোনও সুস্থ-সবল বাচ্চাকে যাতে এ ভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে না দেওয়া হয়, তার আশ্বাস চাই।’’ চ্যাং হাসপাতালের কর্তারা অবশ্য গোটা বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।