পড়শি দাদুর আদর। পরীক্ষার ফল জানার পরে পাটুলির বাড়িতে স্বাগতম হালদার। সোমবার দেবস্মিতা ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
আমির-সলমন তাঁর বন্ধু নন। কোহালি-রাহানের সঙ্গেও বিশেষ জমে না তাঁর। তাই আমির-সলমনদের পেশিশক্তি বা বন্দুক তাঁকে টানে না। কোহালি-রাহানেদের ব্যাট-বলও না। তাঁর আগ্রহ বেশি মগজাস্ত্রে। আর অবসর সময়টা কাটাতে পছন্দ করেন সেই মগজাস্ত্রের প্রবক্তা ফেলুদার সঙ্গেই। আরও ঠিকঠাক বললে ফেলুদার স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে।
তাঁর মগজাস্ত্রও যে অত্যন্ত ক্ষুরধার, তার প্রমাণ পাওয়া গেল সোমবার, উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বেরোনোর পরে। ৯৯ শতাংশ নম্বর পেয়ে তিনি ওই পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। তিনি স্বাগতম হালদার। দক্ষিণ কলকাতার পাটুলির বাসিন্দা, পঞ্চসায়র শিক্ষা নিকেতনের ছাত্র।
এ বার মাধ্যমিকের প্রথম সৌভিক বর্মন খেলাধুলো পছন্দ করে। উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম স্বাগতমের কিন্তু বিশেষ আগ্রহ নেই খেলাধুলোয়। টান নেই সিনেমার প্রতিও। সময় কাটান গল্পের বই পড়ে আর ডিসকভারি চ্যানেল দেখে। গল্পের মধ্যেও প্রিয় সত্যজিতের রচনা। সত্যজিতের প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলু মিত্তিরকে ভারী পছন্দ স্বাগতমের। এতটাই যে, উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম হওয়ার দিনে জানিয়ে দিলেন, কোনও দিন যদি ফেলু মিত্তির হওয়ার সুযোগ পান, তবে তোপসের চরিত্রে থাকবে বোন সায়ন্তনী। কেন? স্বাগতম বললেন, ‘‘আমার সব কাজে, সব সময় ওকে পাশে পেয়েছি। ওর থেকে ভাল বন্ধু আর কেউ নেই আমার।’’
সোমবার যখন নিজের বাড়িতে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছেন দাদা, পাশে বোন হাসিমুখে বলছে, ‘‘টিভিতে দাদার নাম শুনে আমি লাফিয়ে উঠেছিলাম। চিৎকার করে দাদাকে বললাম, ‘দাদা তোর নামটাই বলছে’!’’ বাড়ির ছেলেকে ঘিরে যখন চেনা-অচেনা বহু লোকের ভিড়, ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে মা চন্দ্রাণী হালদার বলছেন, ‘‘আমার মনে যে কী হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারব না। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই।’’ তিনি নিজে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষিকা। ছোটবেলা থেকেই ছেলের লেখাপড়ার দেখভাল করছেন তিনিই। চন্দ্রাণীদেবী জানান, পড়ার জন্য স্বাগতমের কোনও ধরাবাঁধা সময় ছিল না। যত ক্ষণ ইচ্ছে হতো, তত ক্ষণই পড়তেন।
মায়ের মতো ছেলেরও আগ্রহ পদার্থবিজ্ঞানে। স্বাগতম জানান, বাবার মতো চিকিৎসক নয়, তিনি হতে চান গণিত বা পদার্থবিজ্ঞানের গবেষক। স্বাগতমের বাবা বললেন, ‘‘কখনওই কোনও বিষয় নিয়ে চাপ দেওয়া হবে না।
ও যেটা নিয়ে পড়তে পছন্দ করবে, সেটাই পড়বে।’’
স্বাগতমের সাফল্যে খুশি তাঁর স্কুলও। ওঁর জন্য স্কুলে অপেক্ষা না-করে সটান বাড়িতেই পৌঁছে যান শিক্ষিকা কাবেরী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, মাধ্যমিকে নবম হয়েছিলেন স্বাগতম। এ বার একেবারে প্রথম।
মগজাস্ত্রের ধার কতটা, স্বাগতমের সঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছেন আরও চার জন। মেধা-তালিকার প্রথম তিনটি স্থান দখল করেছেন ওই পাঁচ জনই।
দক্ষিণ কলকাতায় বসে স্বাগতম যখন স্বপ্নের ঘোরে, কোচবিহারে হতচকিত নভোনীল দেব বলছেন, ‘‘দিদিমা তা হলে ঠিকই বলেছিল!’’ উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় হয়েছেন কোচবিহার জেনকিন্স হাইস্কুলের ছাত্র নভোনীল। রবিবার রাতে দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছিল না তাঁর। দিদিমা কল্যাণী নন্দী মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘‘চিন্তা করিস না, তুই প্রথম দশে থাকবি।’’ দিদিমার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল খুব, কিন্তু সাহস হচ্ছিল না। এ দিন ফল প্রকাশের পরে নভোনীল বললেন, ‘‘পরিবারকে এতটা আনন্দ দিতে পেরেছি, ভেবেই খুব আনন্দ হচ্ছে।’’ আইআইটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চান তিনি। নভোনীলের মা তৃণাদেবী জানান, ক্লান্ত হয়ে গেলেই গিটার নিয়ে বসে পড়েন নভোনীল। গুনগুন, টুংটাংয়ের তালিকায় রবীন্দ্রনাথ থেকে বিটলস, অরিজিৎ সিংহ— বাদ পড়েন না কেউই। দিদিমা কল্যাণীদেবী বলেন, “শিক্ষিকা ছিলাম। নভোনীলকে চিনতে ভুল করেনি আমার চোখ।” স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেবব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “নভোনীলকে নিয়ে আমরা আশায় ছিলাম। সেই আশা পূরণ হয়েছে।”
নভোনীলের সঙ্গেই দ্বিতীয় স্থানে আছেন উত্তরবঙ্গের আরও দু’জন। যখন ইচ্ছে তখন নয়, নিয়ম করে, রুটিন মেনে পড়ে নভোনীলের সঙ্গে একই নম্বর পেয়েছেন দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট হাইস্কুলের ছাত্র স্বর্ণাভ নন্দী। দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তে স্বর্ণাভ-নভোনীলের সঙ্গে একাসনে ময়নাগুড়ি সুভাষনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র সঞ্জয় সরকারও। স্বর্ণাভের নেশা পড়ার ফাঁকে ক্যামেরা নিয়ে ছাদে উঠে গাছগাছালিতে নজর রেখে পাখিদের ছবি তোলা। আর বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট। পরিবারের আশা ছিল, তিনি ভাল ফল করবেন। টিভিতে ছেলে দ্বিতীয় হয়েছেন শুনে আনন্দে আপ্লুত বাবা সঞ্জয় নন্দী আর মা মিঠুদেবী। স্বর্ণাভের সাফল্যে খুশি তাঁর স্কুলও।
নম্বরে স্বর্ণাভ-নভোনীলের সমান, তবে লড়াইয়ে ওঁদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে সঞ্জয়। বাবা সুবল সরকার ময়নাগুড়ি ব্লকের বিভিন্ন হাটে ঘুরে ঘুরে পাট এবং তামাক কেনাবেচা করেন। সামান্য কিছু জমি আছে। সুবলবাবুর দুই মেয়ে, এক ছেলে। সঞ্জয়ই ছোট। সীমাহীন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে তাঁকে। আর সেই অভাবের যন্ত্রণাই তাঁকে লড়াইয়ে প্রেরণা জোগায়, জানাচ্ছেন সঞ্জয়। তিনি বলেন, ‘‘এখনও অনেকটা পথ চলতে হবে। আমার ইচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার।’’
উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম স্থান পাওয়াটা স্বাগতমের কাছে আকস্মিক মনে হলেও নিজের উপরে প্রবল বিশ্বাস ছিল নীলাঞ্জনার। আরামবাগ গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী নীলাঞ্জনা সাহা সার্বিক ভাবে তৃতীয় হয়েছেন, মেয়েদের মধ্যে প্রথম। শুধু বই নিয়েই থাকতে পছন্দ করেন না নীলাঞ্জনা। ভালবাসেন ছবি আঁকতে, গান গাইতে। নীলাঞ্জনা জানালেন, ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করতে চান।
নীলাঞ্জনা যে এক দিন তাঁদের গর্ব হয়ে উঠবেন, সেটা জানতেন তাঁর স্কুলের শিক্ষিকারা। শিক্ষিকা স্বপ্না মিস্ত্রি বললেন, “পঞ্চম শ্রেণি থেকেই নীলাঞ্জনা আমাদের স্কুলের ছাত্রী। পড়াশোনায় অত্যন্ত মনোযোগী মেয়েটা প্রথম থেকেই নজর কেড়েছিল। ভদ্র, শ্রদ্ধাশীল।” মেয়ের এই সাফল্যে খুশি প্রতিমা সাহা। তিনি বললেন, ‘‘মেয়ে এতটা ভাল করবে, ভাবিনি। বিরাট কিছু পড়াশোনা যে করেছে, তা-ও নয়। তবে যখন পড়ত, ভীষণ মনোযোগ দিত।’’
নীলাঞ্জনার চোখে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। অধ্যাপনা করতে চান তিনি।