কল্যাণ কীসে, চলছে শুধু তাল ঠোকাঠুকিই

মহিলা ও শিশুদের অধিকার, কল্যাণ ও সুরক্ষা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে কমতি নেই। কিন্তু তার সাফল্যের জন্য যেটা সর্বাগ্রে দরকার, সেই কেন্দ্র-রাজ্য বোঝাপড়ায় বিপুল ঘাটতি।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:০৯
Share:

মহিলা ও শিশুদের অধিকার, কল্যাণ ও সুরক্ষা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে কমতি নেই। কিন্তু তার সাফল্যের জন্য যেটা সর্বাগ্রে দরকার, সেই কেন্দ্র-রাজ্য বোঝাপড়ায় বিপুল ঘাটতি। ফল যা হওয়ার, তা-ই। দিল্লির সঙ্গে পদে পদে ঠোক্কর লাগায় পশ্চিমবঙ্গে নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের একাধিক প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যত শিকেয়।

Advertisement

আর অবস্থা এমনই যে, প্রকাশ্যে চোখের জল পর্যন্ত ফেলতে হচ্ছে আধিকারিকদের। সম্প্রতি টেলিফোনে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রী মেনকা গাঁধীর ধমক খেয়ে সর্বসমক্ষে কেঁদে ফেলেছিলেন রাজ্যের এক সমাজকল্যাণ-কর্তা। গত ২১ নভেম্বর দিল্লিতে মন্ত্রক আয়োজিত এক আলোচনাসভায় স্বয়ং মেনকাও ঘটনাটি উল্লেখ করেন। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে নবান্নের ‘অনাগ্রহের’ কথা জানিয়ে মেনকার কটাক্ষ, ‘‘এমন কেউ আছেন, যিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে

বোঝাতে পারেন? জানি না, ওঁর সমস্যাটা কোথায়!’’

Advertisement

এ হেন প্রেক্ষাপটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনের সাম্প্রতিক ‘দিল্লি-বিরোধী জেহাদ’ নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা পেয়েছে। বাড়ছে বিতণ্ডার বহর। মেনকা তথা তাঁর মন্ত্রকের কিছু পদস্থ আমলার বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ এনে রাজ্যের দাবি: স্রেফ জেদের বশেই দিল্লি কিছু অপ্রয়োজনীয় ও অবাস্তব প্রকল্প এখন রাজ্যের ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছে। ‘‘ওরা যে যে প্রকল্পের কথা বলছে, সেগুলো এখানে অনেক আগে থেকেই অন্য নামে চলছে, যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে। অথচ ওরা তা ছেড়ে নিজেদেরটা চাপাতে চাইছে।’’— বলছেন রাজ্যের সমাজ কল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজা। তাঁরও প্রশ্ন, ‘‘ওদের এত জেদ কীসের?’’

মতবিরোধের তালিকায় গোড়াতেই আছে শিশু নিরাপত্তা কমিটি (চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি, সংক্ষেপে সিডব্লিউসি)। অনাথ, অত্যাচারিত বাচ্চাদের দেখভাল, হোমের পরিকাঠামো ও দত্তক প্রক্রিয়ায় নজরদারির মতো গুরুদায়িত্ব তাদের হাতে।

এ দিকে নিকট অতীতে রাজ্যের একাধিক হোমে শিশু ধর্ষণ ও শিশু গায়েবের ঘটনায় এবং সাম্প্রতিক শিশু পাচার কাণ্ডে একাধিক হোমের নাম জড়িয়েছে। যে সূত্রে সিডব্লিউসি-র ‘গাফিলতি’ নিয়ে চর্চা নানা মহলে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথাতেও তার প্রতিধ্বনি। ‘‘দিনের পর দিন কমিটি বসে না! বাচ্চাদের হোমে রাখা হচ্ছে না, দত্তকও না।’’— আক্ষেপ মেনকার। বহু শিশু ভিতর থেকে পাচার হচ্ছে বলেও দিল্লির অভিযোগ। মন্ত্রকের সচিব লীনা নায়ারের হুঁশিয়ারি, ‘‘দায় এড়ানো যাবে না। কাজ করতেই হবে।’’

এ সব অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়ে তথ্যের যুক্তি সাজাচ্ছে রাজ্য। শশী পাঁজার হিসেবে, হোম পায়নি ও দত্তক দেওয়া যায়নি, রাজ্যে এই মুহূর্তে এমন শিশুর সংখ্যা ১৭২।

এদের অনেকে দত্তকের চূড়ান্ত ছাড়পত্রের অপেক্ষায়। কেন্দ্রের নীতি ও আচরণ সম্পর্কে ক্ষোভ উগরে দিয়ে শশীদেবীর মন্তব্য, ‘‘দিল্লি নিছক রাজনীতির ঘুঁটি সাজাচ্ছে।’’

পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ প্রকল্পের হাল নিয়েও দিল্লির প্রভূত নালিশ। যদিও রাজ্যের দাবি, অল্পবয়সী মেয়েদের সার্বিক উন্নয়নে পশ্চিমবঙ্গের কন্যাশ্রী প্রকল্পই যথেষ্ট। ‘‘আলাদা কিছুর দরকার নেই। অথচ দিল্লি জবরদস্তি চাপাতে চাইছে। মেনে নেওয়া যায় না।’’— বলেন শশী। তবে দিল্লি মনে করে, কন্যাশ্রীর সঙ্গে বেটি বাঁচাওয়ের একটা মূলগত পার্থক্য আছে। মেনকার কথায়, ‘‘কন্যাশ্রীও ভাল। কিন্তু আমাদের বেটি বাঁচাওয়ে মানুষের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তনে জোর দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালে প্রসব ও ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ রুখতে নানা ব্যবস্থার সংস্থান মজুত রয়েছে।’’ তাঁর পর্যবেক্ষণ— কন্যাশ্রীর সঙ্গে সঙ্গেই এটি চালালে পশ্চিমবঙ্গে বিলক্ষণ উপকার হতো। এবং খেদ, ‘‘কিন্তু মমতাকে এটা বোঝাবে কে?’’

এই টানাপড়েনে পশ্চিমবঙ্গে বেটি বাঁচাওয়ের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলেই রাজ্য প্রশাসন সূত্রের ইঙ্গিত। অত্যাচারিতা মেয়েদের সাহায্যার্থে ‘ওয়ান স্টপ সেন্টার’ তৈরি নিয়েও এখন সেই অনিশ্চয়তা।

দিল্লিতে নির্ভয়া ধর্ষণ-খুনের প্রেক্ষিতে গড়া ‘নির্ভয়া তহবিলে’র টাকা খরচের বিভিন্ন পরিকল্পনার একটি হল— যত দ্রুত সম্ভব নিগৃহীতার চিকিৎসা, আইনি সাহায্য ও কাউন্সেলিংয়ের বন্দোবস্ত করতে হাসপাতালের দুই কিলোমিটারের মধ্যে সেন্টারগুলো তৈরি হবে। সারা দেশে প্রথম দফায় ৩৬টি, দ্বিতীয় দফায় ১৫০টি সেন্টার হবে। আপাতত কুড়িটি চালু হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এতেও আগ্রহী নয় বলে অভিযোগ জানিয়েছেন মেনকা। প্রকল্পের উপদেষ্টা জুপাকা মাধবী বলেন, ‘‘কেন আগ্রহী নয়, তার ব্যাখ্যাও পশ্চিমবঙ্গ দেয়নি।’’ কেন নয়?

শশীর জবাব, ‘‘ধর্ষিতাদের সহযোগিতার জন্য পশ্চিমবঙ্গে থানায়, হাসপাতালে আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। রাজ্য ও জেলাস্তরের লিগাল এড সোসাইটিও আছে।’’ তাই রাজ্যের আলাদা করে ওয়ান স্টপ কেন্দ্র দরকার নেই বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন