অ্যায় দিল থেকে রক অন, ঘা মন্দার

ব্যাঙ্ক-এটিএমের চক্করে সিনেমা হল খাঁ খাঁ

ওঁরা, মানে সিনেমা হলের কর্মী-ম্যানেজার। টিকিট কাউন্টার যখন মাছি তাড়াচ্ছে, তখন হঠাৎ দেবদূতের মতো চার মূর্তির আবির্ভাব হয়েছিল। ‘দর্শক-নারায়ণ’ যাকে বলে। তাঁদের নাছোড় আবদার— দেড়শো টাকার চারটে টিকিট চাই! কিন্তু দাম নিতে হবে হাজার টাকার নোটে। খুচ

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৮
Share:

ফাঁকা টিকিট কাউন্টার। সোমবার ধর্মতলার একটি সিনেমা হলে। — রণজিৎ নন্দী

এমন ‘অফার’ যে আসতে পারে, ওঁরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।

Advertisement

ওঁরা, মানে সিনেমা হলের কর্মী-ম্যানেজার। টিকিট কাউন্টার যখন মাছি তাড়াচ্ছে, তখন হঠাৎ দেবদূতের মতো চার মূর্তির আবির্ভাব হয়েছিল। ‘দর্শক-নারায়ণ’ যাকে বলে। তাঁদের নাছোড় আবদার— দেড়শো টাকার চারটে টিকিট চাই! কিন্তু দাম নিতে হবে হাজার টাকার নোটে। খুচরোটা ফেরত না-দিলেও চলবে।

অর্থাৎ, বাতিল হাজার পার করার জন্য চারশো যদি গচ্চা যায়, তা-ই সই!

Advertisement

খাস কলকাতার ঘটনা। শোনালেন লেকটাউনের জয়া সিনেমা হলের ম্যানেজার অভিজিৎ দে। ‘‘সিনেমাহলের লাইনে কয়েক দশক কাটিয়ে ফেললাম। এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম! চারশো টাকা বাড়তি দিতেও আপত্তি নেই!’’— ঘোর কাটেনি তাঁর। শেষমেশ অবশ্য ওঁরা ‘অফার’ গ্রহণ করেননি। মন্দার বাজারে এমন দর্শককে ফিরিয়ে দিতে বাধো-বাধো ঠেকলেও বাতিল হাজারের নোট নিতে সাহস করেননি।

নোট-আকালের জমানায় তামাম দেশে সিনেমা হলের ছবিটা মোটামুটি এ রকমই। দর্শকের আকাল। কোথাও শো বাতিল করতে হচ্ছে। কোথাও গুটিকয় যে ক’জন আসছেন, তাঁদের অধিকাংশের কাছে সিনেমা দেখাটা উপলক্ষ্য মাত্র। পাঁচশো বা হাজারের নোট গছিয়ে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টাতেই অনেকে টিকিট কাউন্টারে হাত গলাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের ফিল্ম ট্রেড সংক্রান্ত অ্যানালিস্ট পঙ্কজ লাডিয়ার কথায়, ‘‘যা অবস্থা, তাতে এটাই তো প্রত্যাশিত। লোকে ব্যাঙ্কে-এটিএমে লাইন দিতে ব্যস্ত থাকলে সিনেমা দেখবে কখন?’’

পরিণাম যা হওয়ার, তা-ই। গুজরাতের বডোদরা, আমদাবাদ থেকে মুম্বইয়ের নরিম্যান পয়েন্টের মাল্টিপ্লেক্সেও ছুটির দিনে দর্শকাভাবে কর্ণ জোহরের হেভিওয়েট ছবি মুখ থুবড়ে পড়েছে। শো বাতিল হয়েছে। এমনকী, আগামী শুক্রবার বলিউডের দু’টো ছোটখাটো ছবির রিলিজও শিকেয়! কলকাতার হলগুলো তা-ও তুলনায় ভাগ্যবান। অন্তত নমো-নমো করে শো চলছে। লোকের হাতে নগদ না-থাকলেও ‘বুক মাই শো’ জাতীয় কিছু মোবাইল অ্যাপের দৌলতে খানিক মুখরক্ষা।

কিন্তু মফস্‌সলে তো সেটি হওয়ার যো নেই!

শনিবার ‘ম্যাটিনি’তে যেমন গুসকরার বিদ্যাসাগর ও জলপাইগুড়ির আর্ট সিনেপ্লেক্স থেকে কর্মচারীদের বিমর্ষ ফোন গিয়েছে জনৈক মেজকর্তা দেবাশিস সেনগুপ্তের কাছে। মন্দার বাজারে ফাটকা খেলতে গিয়ে বাজারচলতি ছবি সরিয়ে ক’মাস আগের এক গোয়েন্দা-কাহিনি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা। চিঁড়ে ভেজেনি। সপ্তাহান্তেও তিন-চার জনের বেশি দর্শক নেই শুনে দেবাশিসবাবু বাধ্য হয়ে বলেছেন, তা হলে আর শো চালিয়ে কাজ নেই। লাইট, এসি’র খরচের অর্ধেকও তো উঠবে না!

এমতাবস্থায় সিনেমা শিল্প নেতিয়ে পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। পড়েছেও। কী রকম?

ফিল্ম ব্যবসা সংক্রান্ত পত্রিকা ‘বক্স অফিস ইন্ডিয়া’র হিসেবে, পাঁচশো–হাজারি নোট বাতিলের জেরে গোটা দেশে সিনেমার ৬০% কারবার মার খেয়েছে। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ফারহান আখতারের মিউজিক্যাল ড্রামা ‘রক অন টু’র উপরে চোট সবচেয়ে বেশি। আনকোরা ছবিটি প্রথম সপ্তাহান্তে সারা দেশে ব্যবসা করেছে টেনেটুনে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার। যেখানে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মোটামুটি সফল ছবিও ‘উইক এন্ড কালেকশন’ মারফত এর প্রায় তিন গুণ টাকা ঝুলিতে ভরে ফেলে। কলকাতার ধর্মতলাপাড়ার নামজাদা সিঙ্গলস্ক্রিন প্যারাডাইস-এ ‘রক অন টু’র প্রথম দিনের কালেকশন দশ হাজারও ছাড়ায়নি। অথচ মারকাটারি ছবির ওপেনিং ডে’তে এগারোশো আসনের হলটির রোজগার মোটামুটি সওয়া দু’লাখ টাকা বাঁধা বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। তৃতীয় সপ্তাহে পা রাখা কর্ণের ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ বা অজয় দেবগণের ‘শিবায়ে’র ভাগ্যও পুরোদস্তুর ‘সিল’ করে দিয়েছে এই সপ্তাহান্ত। ইন্ডাস্ট্রি সূত্র জানাচ্ছে, গত শুক্র-শনি-রবিবারে গোটা দেশে দু’টি ছবির কারও কপালে তিন কোটির বেশি জোটেনি।

পাশাপাশি এই সপ্তাহে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কলকাতায় কলম্বাস’-এর প্রযোজক জয় সেনগুপ্ত হাত কামড়াচ্ছেন। মির, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, ঋতাভরী, তনুশ্রীদের শ্লেষাত্মক কমেডি ছবিটির রিপোর্ট মোটামুটি ভাল। তবে সময়টাই সব গোলমাল করে দিয়েছে। জয়ের কথায়, ‘‘রবিবার সন্ধেয় একটু ভিড় হয়েছিল। অন্য সময় হলে ডবল ভিড় হতো।’’ ছবির প্রথম সপ্তাহান্তের কালেকশন গড়ে ৩০-৪০ শতাংশের মধ্যে ঘুরঘুর করছে।

কলকাতায় চলতি সরকারি চলচ্চিত্র উৎসবে যাঁরা ছবি দেখাচ্ছেন, তাঁদের দশাও তথৈবচ। হাতিবাগানের মিত্রা-র দীপেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র কিংবা প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের নবীনা প্রেক্ষাগৃহের নবীন চোখানির আক্ষেপ— ‘‘ক্যাশের টানাটানি তো বটেই। তার উপরে ফেস্টিভ্যালের ছবির টিকিট অনলাইনে কাটা যাচ্ছে না। সে কারণেও টিকিট বিক্রি একেবারে তলানিতে!’’ পোড়খাওয়া ফিল্ম পরিবেশক অরিজিৎ দত্তের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এ সপ্তাহে এমনিতেই টালিগঞ্জের বিগ বাজেট কোনও ছবির রিলিজ নেই। এটাই রক্ষে।’’ রাজ্যের গ্রাম-মফস্‌সলে ১৭-১৮টি হলের কর্ণধার অশোক ধানুকার হিসেব অনুযায়ী, ওই সব তল্লাটে তেমন ভাল ছবি না-থাকলে টিকিট বিকোয় বড়জোর ১৫%-২০%। এখন মেরেকেটে হলের শতকরা দশ ভাগ আসনও ভরছে না!

এ দিকে আগামী সপ্তাহে টলি-বলি-হলিউডের একাধিক ছবি রিলিজ হওয়ার কথা। বলিউডের ‘ফোর্স টু’ ছাড়া বাকি সবগুলো মূলত শহুরে দর্শকের জন্য, অর্থাৎ মাল্টিপ্লেক্সের ছবি। এর মধ্যে হ্যারি পটারের স্রষ্টা জেকে রাউলিংয়ের লেখা ‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস অ্যান্ড হোয়্যার টু ফাইন্ড দেম’-এর দিকে অনেকের নজর রয়েছে। ঋতুপর্ণা অভিনীত ‘তিন অঙ্ক’, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঠাম্মার বিয়ে’, সাহেব ভট্টাচার্য-জুনদের ‘রোম্যান্টিক নয়’ বা ‘তুম বিন টু’র মতো ছবির মুক্তিও পিছনো মুশকিল। তবে হরর ফিল্ম ‘সাঁসে’ বা থ্রিলার ‘থার্টি মিনিটস’-এর রিলিজ পিছিয়ে গিয়েছে। ‘থার্টি মিনিটস’-এর কলকাতার পরিবেশক শতদীপ সাহা বললেন, ‘‘চল্লিশটার মতো হল আমরা পাচ্ছিলাম। কিন্তু এই বাজারে কোনও সিনেমা সুবিধা করতে পারছে না দেখে প্রডিউসার ছবি রিলিজ করতে রাজি হলেন না।’’

দর্শক-ভাগ্য খোলার আশায় ওঁরা আপাতত ডিসেম্বরের দিকে তাকিয়ে। যদিও তার আগেই এসে পড়তে চলেছে বলিউডের বহু প্রতীক্ষিত বড় লগ্নি— ডিয়ার জিন্দগি। শাহরুখ খান-আলিয়া ভট্ট অভিনীত ছবিটির মুক্তি পাওয়ার কথা এ মাসের শেষে, ২৫ নভেম্বরে।

তত দিনে নোট-সঙ্কট কেটে যাবে ভেবেই আশায় বুক বাঁধছে দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন