আমরি-স্মৃতি বহরমপুরে, হাসপাতালে লাগল আগুন, ভিড়ের চাপে মৃত ২ মহিলা

এক জন এসেছিলেন ভর্তি থাকা অসুস্থ ছেলেকে দেখতে। এক জন আয়া। আর, সবাই যখন দৌড়ে নামছে, সিঁড়িতে মামির হাত থেকে ছিটকে নীচে পড়ে গিয়েছিল আড়াই বছরের মেয়ে— বলছেন সেই মামিই।

Advertisement

অনল আবেদিন ও শুভাশিস সৈয়দ

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৩৮
Share:

আগুনের বলি। মৃত উজ্জ্বলা হাজরা এবং কাবেরী সরকারের দেহ রাখা হাসপাতালের মেঝেতে। — নিজস্ব চিত্র

এক জন এসেছিলেন ভর্তি থাকা অসুস্থ ছেলেকে দেখতে।

Advertisement

এক জন আয়া।

আর, সবাই যখন দৌড়ে নামছে, সিঁড়িতে মামির হাত থেকে ছিটকে নীচে পড়ে গিয়েছিল আড়াই বছরের মেয়ে— বলছেন সেই মামিই।

Advertisement

শনিবার তিন জনেরই নিথর দেহ উদ্ধার হল বহরমপুরের মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পাঁচ বছর আগের শীতে কলকাতার আমরি (এএমআরআই) হাসপাতালের স্মৃতি উস্কে দিয়ে অগ্নিকাণ্ডে আরোগ্য নিকেতন আবার হয়ে উঠল মৃত্যুপুরী। দুই মহিলা মারা গেলেন ভিড়ের চাপে। শিশুটির মৃত্যুর সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের যোগ নেই বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি। তবে গোটা ঘটনায় অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা করে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন।

শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ হাসপাতালের দোতলায় একটি বন্ধ ঘরে আগুন লাগে। ডাক্তারেরা অনেক সময়ে ওই ঘরে বিশ্রাম নেন। ভিআইপি কেউ (এমনকী রাষ্ট্রপতিও) জেলায় এলেও ওই ঘরটিই আপৎকালীন পরিস্থিতির

জন্য তৈরি রাখা হয়। হাসপাতাল সূত্রের খবর, এ দিন ওই বন্ধ ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয় বেরোনোর জন্য হইচই। বিপত্তি ঘটে তখনই।

পুলিশ ও মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের বক্তব্য, হুড়োহুড়ির সময়ে ভিড়ের চাপে জখম হয়ে যে দু’জন মারা গিয়েছেন, তাঁদের এক জন নদিয়ার পলাশি থেকে ছেলেকে দেখতে আসা উজ্জ্বলা হাজরা (৪৫)। দ্বিতীয় জন ওই হাসপাতালেরই আয়া কাবেরী সরকার ওরফে মামনি (৪০)। তাঁর বাড়ি বহরমপুর লাগোয়া সুন্দর কলোনিতে। পল্লবী মণ্ডল নামে শিশুটির দেহ উদ্ধার হয় বিকেলে, হাসপাতালেরই একটি ঘরে।

এ দিন সকালেই সুতি থেকে এনে তিনতলায় শিশু বিভাগে ভর্তি করানো হয়েছিল পল্লবীকে। তার পরিবারের দাবি, আগুন লেগেছে শুনে মামি লীলাবতী মণ্ডল তাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে পল্লবী তাঁর হাত থেকে ছিটকে পড়ে। লীলাবতীরও পা ভাঙে পড়ে গিয়ে। বহুক্ষণ শিশুটির খোঁজ পাননি বাড়ির লোকেরা। বিকেলে পল্লবীর মৃতদেহ মেলে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, নিউমোনিয়ায় আগেই মৃত্যু হয়েছিল শিশুটির। ভারপ্রাপ্ত সুপার অজয় রায় বলেন, ‘‘আমার কাছে খবর, বাচ্চাটি আগেই মারা গিয়েছিল। অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বলে শুনেছি।’’

শনিবারের ঘটনায় জখম হয়েছেন অন্তত ১৭ জন। আগুনের কারণ রাত পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, এসি থেকে আগুন লেগেছে। স্থানীয় দমকল সূত্রেও তা-ই জানা গিয়েছিল। কিন্তু পরে পূর্ত দফতর দাবি করে, ওই ঘরে পাতা ম্যাট্রেসে প্রথম আগুন লেগেছিল। দুপুরেই মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করা হবে। এটা নিছক দুর্ঘটনা না অন্য কিছু, তা দেখা হবে।’’ দমকলমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘এই আগুন কোনও সাধারণ আগুন নয়।’’ পরে একই সঙ্গে দু’টি তদন্ত চালুর কথা জানিয়ে দেয় নবান্ন। একটি চালাবে স্বাস্থ্য দফতর, অন্যটি সিআইডি।

এ দিন আগুন যখন লাগে, তখন অস্থি বিভাগে রোগী দেখছিলেন চিকিৎসক ওয়াসিম বারি। তাঁর কথায়, ‘‘বেলা ১১টা ৩৫ নাগাদ ধোঁয়ার গন্ধ পাই। নীচে ছুটে গিয়ে ওয়ার্ড মাস্টারকে জানাই।’’ ওই ঘরের চাবি থাকে পাশের সিস্টার রুমে। কিন্তু ওই ছোটাছুটির মধ্যে সিস্টার রুমে কেউ ছিলেন না। ফলে চাবিও মেলেনি। তিনতলার শিশু বিভাগ, এসএনসিইউ থেকে শুরু করে নানা ওয়ার্ডে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। পড়িমরি স্যালাইনের বোতল, চ্যানেল হাতে নিয়ে, অক্সিজেনের নল নাক থেকে খুলে নীচে নামার চেষ্টা করতে থাকেন রোগীরা। গুরুতর অসুস্থদের কাউকে কাউকে স্ট্রেচারে নামিয়ে আনা হয়।

আগুন লাগায় লিফট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বাড়ির এক প্রান্তে আপৎকালীন দরজাটি ছিল তালাবন্ধ। র‌্যাম্পেও ছিল তালা। ফলে একতলায় নামার উপায় বলতে ছিল একটিই মাত্র সিঁড়ি। সেখান দিয়েই সকলে ধাক্কাধাক্কি করে নামতে থাকেন। হাসপাতাল সূত্রের বক্তব্য, এই সময়ে জখম হন অন্তত ১৭ জন। তাঁদের মধ্যে আট জন রোগীর বাড়ির লোক, ছ’জন মেডিক্যালের পড়ুয়া, দু’জন নার্স। হাসপাতালেই চিকিৎসা করে সন্ধ্যায় ১৬ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সরকারি হাসপাতালে আগুন লাগা এই প্রথম নয়। ২০১১ সালের ৯ ডিসেম্বর আমরির অগ্নিকাণ্ডে ৯৩ জনের মৃত্যুর মতো বড় ঘটনা হয়তো ঘটেনি। কিন্তু কলকাতা মেডিক্যাল, এসএসকেএম, এনআরএস-এর পাশাপাশি নানা জেলার সরকারি হাসপাতালে আগুন লেগেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আগুন লেগেছিল এসি থেকে। দিন ছয়েক আগে, গত ২১ অগস্ট এসি থেকেই কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে আগুন লেগেছিল।

ঘটনাচক্রে, এ বার আগুন লেগেছে সেই মুর্শিদাবাদে, যা কিছু দিন আগেও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর ‘গড়’ বলে পরিচিত ছিল। যেখানকার রাশ হাতে নিতে শুভেন্দু অধিকারীকে বিশেষ দায়িত্ব দেন মমতা। এবং তার পর থেকে একাধিক বিরোধীকে দলে টেনে মুর্শিদাবাদে নিজেদের দখল অনেকটাই কায়েম করেছে তৃণমূল। প্রত্যাশিত ভাবেই, অগ্নিকাণ্ডের পরেই রাজ্য সরকারের দিকে আঙুল তুলেছেন অধীর। মৃতদের পরিবারের জন্য দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে রাজ্য। অধীর মৃতদের জন্য ১০ লক্ষ ও আহতদের জন্য ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। বহরমপুরের সাংসদের কটাক্ষ, ‘‘‘মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য দফতর চালাতে ব্যর্থ। অবিলম্বে ওঁর অন্য কাউকে পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এখন উনি সামাল দিতে নেমেছেন। কিন্তু তদন্তে যে দোষীকে আড়াল করা হবে, তা এখনই বলে দেওয়া যায়।’’

মমতার নির্দেশে রাতেই পরিবহণ মন্ত্রী তথা তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারী, স্বাস্থ্য দফতরের মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এক্সপার্ট গ্রুপের চেয়ারপার্সন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বহরমপুরে পৌঁছন। চন্দ্রিমা বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কালিমালিপ্ত করার একটা চক্রান্ত এই জেলায় বহু দিন ধরেই হচ্ছে। হাসপাতালেও একটা চক্র ষড়যন্ত্র করছিল। তাই সিআইডি-কে তদন্তভার দেওয়া হয়েছে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement