দলেরই পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে দুধকুমার

ভোটের আগে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার মামলায় একই দিনে জামিন হয়েছিল বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ও বিজেপির প্রাক্তন জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের। জল্পনা শুরু হয়, অনুব্রত এবং দুধকুমার, দুই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হওয়া পুলিশি তদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট একই দিনে আদালতে জমা পড়া নিয়ে।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৫ ০০:৫৩
Share:

ভোটের আগে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার মামলায় একই দিনে জামিন হয়েছিল বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ও বিজেপির প্রাক্তন জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের। জল্পনা শুরু হয়, অনুব্রত এবং দুধকুমার, দুই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হওয়া পুলিশি তদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট একই দিনে আদালতে জমা পড়া নিয়ে। আর এ বার দলেরই একটি পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের অভিযোগ তুলে সরব হলেন বীরভূমের দাপুটে বিজেপি নেতা, প্রাক্তন জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল। সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত প্রধান এবং অঞ্চল সভাপতির দাবি, সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দলে কোণ ঠাসা হয়ে পড়েছেন তিনি। তাই দলকে কালিমালিপ্ত করতেই ভিত্তিহীন অভিযোগ করছেন। বিজেপি পরিচালিত ময়ূরেশ্বর পঞ্চায়েতের ঘটনা।

Advertisement

দুধকুমারবাবুর দাবি, চলতি বছরে ওই পঞ্চায়েতে ৫৬,৪৫০ টাকা দিয়ে বিভিন্ন আনুসঙ্গিক সরঞ্জাম সহ একটি ল্যাপটপ কেনা হয়। একই সঙ্গে ৬,৯৫০ টাকা দিয়ে কেনা হয় ল্যাপটপের সরঞ্জাম। কিন্তু ওইসব সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে কোনও টেন্ডার ডাকা হয়নি। নেওয়া হয়নি দরপত্রও। আর্থিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে অল্প দামের সামগ্রী বেশি দামে কেনা বলে দেখানো হয়েছে। নিয়ম রক্ষার্থে তিনটি দোকানের ফাঁকা দরপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে বলে। তাঁর অভিযোগ, ‘‘ফাঁকা ওইসব দরপত্র তো বটেই, যে সংস্থাকে বিল দেওয়া হয়েছে তাদের রসিদেও পঞ্চায়েতর নামের কোনও উল্লেখ নেই। আমি ওইসব ফাঁকা দরপত্র এবং রসিদ পঞ্চায়েত থেকেই সংগ্রহ করে এক কর্মীকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়ার পর প্রশাসনের দৃষ্টি আর্কষণ করি। কিন্তু আজও কোনও তদন্ত হয়নি। আসলে প্রশাসনেরই কিছু কর্মীও ওই তছরূপের সঙ্গে জড়িত বলেই ফাঁকফোঁকর ভরাটের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সময় পার করে চলেছে।’’

প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে ওই তছরূপের তদন্তের দাবি জানিয়েও কোন কাজ হয়নি বলে দুধকুমারবাবু জানান। বলেন, ‘‘মাঝখান থেকে অভিযোগ জানানোর খবর প্রকাশ্যে আসায় দলীয় নেতা-কর্মীদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে আমাকে।’’ একই অভিযোগ উঠেছে, কেন্দ্রীয় ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের টাকা খরচ নিয়েও। ময়ূরেশ্বর ২ নং ব্লকের বিডিও সৈয়দ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘ওই অভিযোগের তদন্ত চলছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর দুর্নীতি প্রমাণিত হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

Advertisement

দুধকুমারের অনুগামীদের দাবি, পঞ্চায়েতে বিভিন্ন কাজের জন্য চলতি বছরে ওই প্রকল্পে বরাদ্দ হয় ৩ লক্ষ ৮৭ হাজার টাকা। প্রায় ৪০ শতাংশ ছাড়ে ওই টাকায় বিভিন্ন কাজের বরাত দেওয়া হয় ৪ জন ঠিকাদারকে। নিয়মানুযায়ী ছাড়ের টাকায় সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে উদ্বৃত্ত কাজ কিংবা উন্নয়নমূলক অন্য কোনও কাজ কাজ করার কথা পঞ্চায়েতের। এক্ষেত্রেও কোনও টেন্ডার করা দূরের কথা, কোনও কাজ না করেই ঠিকাদারদের মাধ্যমে প্রায় ১ লক্ষ ৬৯ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনকে জানিয়ে কোনও লাভ হয়নি। দুধকুমার বলেন, ‘‘মাঝখান থেকে বিজেপির স্থানীয় অঞ্চল সভাপতি বিক্রম ঘোষের নেতৃত্বে দলের কর্মী-সমর্থকদের একাংশ অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য আমাকে হেনস্থা করার চেষ্টা করছে।’’

ঘটনা হল, জেলায় দুধকুমার জেলা সভাপতির পদে না থাকলেও এখনও তাঁর অনুগামীরা তাঁকে মেনে চলেন। রাজ্য নেতৃত্বেরও একটি মহল মনে করে, অনুব্রতকে টক্কর দিতে দুধকুমারই ঠিক লোক। জেলার রাজনীতিতে পরিচিত মুখ দুধকুমার রামমন্দির আন্দোলনের সময় থেকেই জনপ্রিয়। যে এলাকার পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই এলাকায় সেই তখন থেকেই বিজেপি-কে, কার্যত একাই দাঁড় করানোর কৃতিত্ব যে তাঁরই, মানছেন জেলার রাজনৈতিক মহল। ময়ূরেশ্বরের ভোটের ফলাফলেও সেই সত্যতার প্রমাণ মিলেছে। দুধকুমার বিজেপি-র কাজ শুরু করেন ১৯৯১ সালে। ১৯৯৩ সালে ময়ূরেশ্বরের পঞ্চায়েত দখল করে তারা। আশপাশের পঞ্চায়েতগুলিতেও প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়েছিল বিজেপি। ১৯৯৮ সালেও সেই সব পঞ্চায়েতের দখল ধরে রেখেছিল বিজেপি। সে বার দুধকুমার পঞ্চায়েত সমিতিতে জিতে তাক লাগিয়ে দেন। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনেও প্রার্থী হন তিনি।

লোকসভা ভোটের আগে দুই মণ্ডলের ‘লড়াই’ জমে উঠলেও, ময়দান থেকে ছিটকে যান দুধকুমার। পুরভোটের লড়াই ঠিকমতো শুরু হওয়ার আগেই রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ জানিয়ে বীরভূম জেলা বিজেপির সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বসেন তিনি!

ময়ূরেশ্বর পঞ্চায়েত প্রধান ফুলমনি মাড্ডি তছরুপের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘নিয়ম নীতি মেনেই ল্যাপটপ কেনা এবং ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের কাজ হয়েছে। দুধকুমারবাবু উদ্দেশ্য প্রণোদিত কারণে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।’’ ফুলমনির সুর স্থানীয় অঞ্চল সভাপতি বিক্রম ঘোষের গলাতেও। তিনি বলেন, ‘‘দুধকুমারবাবুকে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য কোনও চাপ কিংবা হেনস্থার চেষ্টা করা হয়নি। আসলে সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দলে কোণ ঠাসা হয়ে পড়েছেন উনি। তাই দলকে কালিমালিপ্ত করতেই ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছেন।’’

বিজেপির এই দলীল তরজায় সরব শাসক দলের নেতারাও। তৃণমূলের সংশ্লিষ্ট ময়ূরেশ্বর ২ নং ব্লক সভাপতি নারায়ণ প্রসাদ চন্দ্র বলেন, ‘‘যে দলের নেতারা পান থেকে চুন খসলেই মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন, সেই দলের প্রাক্তন জেলা সভাপতিই যখন নিজেদের অধীনে থাকা পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে তছরুপের অভিযোগ তোলেন, তখন আর সেই পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় থাকা উচিত নয় ওদের।’’

জেলা বিজেপির আহ্বায়ক অর্জুন সাহা অবশ্য বলেন, ‘‘দুধদা আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন। তাঁর অভিযোগ যেহেতু প্রশাসনের কাছে তাই প্রশাসন যা করার করবে। আমাদের দল দুর্নীতি বরদাস্ত করে না। তাই আমরাও গুরুত্ব সহকারে ওই অভিযোগ খতিয়ে দেখব। দুর্নীতি প্রমাণিত হলে দল ব্যবস্থাও নেব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন