রবীন্দ্রনৃত্য শিখতে কান থেকে কাঁচরাপাড়ায়  

ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখার দরকার পড়েনি ফরাসি তরুণীর। রবীন্দ্রনৃত্যের নেশা তত দিনে তাঁর হৃৎকমলে ধুম লাগিয়েছে।   ফ্রান্সের কান-এর বাড়ি ছেড়ে কাঁচরাপাড়ায় ঘটক রোডের দম্পতি মৌমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অজয় দাসের বাড়িতে এসে উঠেছেন জ্যাদঁ দোলোয়া।

Advertisement

সুপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৮ ০২:২২
Share:

জ্যাদঁ দোলোয়া। নৈহাটির ঐক্যতান মঞ্চে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

কান থেকে কাঁচরাপাড়া কত দূর?
ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখার দরকার পড়েনি ফরাসি তরুণীর। রবীন্দ্রনৃত্যের নেশা তত দিনে তাঁর হৃৎকমলে ধুম লাগিয়েছে।
ফ্রান্সের কান-এর বাড়ি ছেড়ে কাঁচরাপাড়ায় ঘটক রোডের দম্পতি মৌমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অজয় দাসের বাড়িতে এসে উঠেছেন জ্যাদঁ দোলোয়া। গুরুর বাড়িতে মাস তিনেক থেকে আলু-পোস্ত আর ঝিঙে চচ্চড়ি দিয়ে সাপটে ভাত-রুটি খেয়ে চালিয়ে গিয়েছেন সাধনা। দিন কয়েক আগে নৈহাটির ঐক্যতান মঞ্চে প্রথম বার নাচলেন বছর কুড়ির তরুণী। ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়’ গানের সঙ্গে নাচ যখন শেষ, গোটা হল উঠে দাঁড়িয়ে হাততালিতে ভরিয়ে দিচ্ছে নীলনয়না বিদেশিনি শিল্পীকে।
১৯৯১ সালে জাপানের ওসাকা শহরে সাধন দাস বৈরাগ্যের গলায় বাউল গান শুনে সহজিয়া সুরে মজেছিলেন মাকি কাজুমি। দেশের মাটি ছেড়ে তিনি পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন গান শিখতে। এখন বাউল জগতের ‘মা-গোসাঁই’ কাজুমি।
রবীন্দ্রনৃত্য নিয়ে চিন্তাভাবনা এখনও দেশ ছাড়ার কথা পুরোপুরি ভাবায়নি মাইক্রোবায়োলজির ছাত্রীটিকে। ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে গবেষণা করতে চান। আর প্রাণের আরাম নাচও ছাড়তে চান না।
শুরুর দিকে দোলোয়াকে অনলাইনে নাচ শেখাচ্ছিলেন মৌমিতা। তাতে মন ভরেনি ছাত্রীর। তাই জুন মাসে সরাসরি বাড়িতে এসে হাজির। শুরুর দিকে যখন গুরুগৃহে মাছের ঝোল খেয়ে পেট ছাড়ল, তখনও তালিম ছাড়েননি তরুণী। মৌমিতা বলেন, ‘‘শরীর খারাপ নিয়েও দেশে ফিরতে চায়নি ও। এত কঠোর পরিশ্রম করতে এর আগে কোনও ছাত্রছাত্রীকে দেখিনি। অনুষ্ঠানের আগের রাতটা দু’চোখের পাতা এক করল না। টানা নেচে গেল।’’
ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলেন দোলোয়া। গুরুর খোঁজ পেলেন কী ভাবে? দোলোয়া জানান, ছোট থেকে নাচে আগ্রহ ছিল। ইউটিউবে বিভিন্ন দেশের নাচের ভিডিয়ো ঘাঁটতে ঘাঁটতে এক দিন চোখে পড়ল রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নাচ। বয়স তখন তাঁর বছর চোদ্দো। গানের আঙ্গিক সম্পর্কে তখনও কিছুই জানেন না। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের সঙ্গে নাচের ললিত বিভঙ্গ দেখে মনে হয়েছিল, এমন কিছুই তো চাইছে মন।
খুঁজতে খুঁজতে জানলেন, ভিডিয়োটি ছিল অজয়ের। তথ্য-তালাশের দুনিয়ায় গুরুর ঠিকানা জোগাড় করা কঠিন ছিল না। অজয় তখন রাজস্থানে একটি স্কুলে নাচ শেখান। খুঁজেপেতে সেখানে পৌঁছে যান দোলোয়া। তিন বছর ধরে এ জন্য টাকা জমিয়েছিলেন। সেখানে কিছু দিন থেকে অবশ্য ফিরতে হয়েছিল। সে বার সামনেই ছিল পরীক্ষা।
এ বার তিনি এসেছেন কাঁচরাপাড়ায়। অজয় ও তাঁর স্ত্রী মৌমিতা দু’জনেই পেশাদার শিল্পী। বছরভর দেশবিদেশে অনুষ্ঠান করেন। অজয় রাজস্থানেই থাকেন। মৌমিতা আপাতত তালিম দিচ্ছেন দোলোয়াকে।
ফিল্মোৎসবের জন্য খ্যাতি ফ্রান্সের কান শহরের। সমুদ্রতীরবর্তী ছোট্ট শহরটিতে বছরভর পর্যটকের আনাগোনা। শহরের এক প্রান্তে বাড়ি দোলোয়ার। বাবা জঁ ফ্রসোয়াঁ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালান। পারিবারিক ব্যবসাও রয়েছে। বাড়িতে বাবা-মা-বোন জুস্টিন ছাড়াও আছে খান দুয়েক ঘোড়া, দু’টো ছাগল, একটা গাধা, দু’টো কুকুর। যাকে বলে ভরা সংসার।
সে সব ছেড়ে এখানে এসে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না? দোলোয়া বলেন, ‘‘আমি তো নাচতেই চেয়েছিলাম। এর থেকে ভাল পরিবেশ আর কোথায় পেতাম? খাবারদাবার নিয়ে প্রথম দিকে অসুবিধা হয়েছিল। এখন ভালই লাগে। এ বার প্রচুর আম খেয়েছি।’’ বাড়ির লোকেদের কথা মনে পড়ে? ‘লিত‌্ল’— একগাল হেসে উত্তর দেন ‘দলুই’। গুরুগৃহে দোলোয়ার ফরাসি নাম বাংলায় এখন এমনটাই দাঁড়িয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন