জীবনের যুদ্ধ থেকে পরীক্ষার খাতা, নম্বর জিতল ওরাই

জংধরা টিনের চাল, মাটির দেওয়াল। মা স্নায়ুরোগে আক্রান্ত। বাবা স্থানীয় চালকলের কর্মী। টানাটানির সংসারের দু’পয়সা বাঁচাতে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতে আলোও জ্বালানো হয় না। এমন অন্ধকার থেকেই উঠে এসে এ বারের মাধ্যমিকে চতুর্থ স্থান দখল করেছে শৌভিক ভট্টাচার্য।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০৩:৪৬
Share:

আলিপুরদুয়ারের বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে রিয়া রায়। — নিজস্ব চিত্র।

জংধরা টিনের চাল, মাটির দেওয়াল। মা স্নায়ুরোগে আক্রান্ত। বাবা স্থানীয় চালকলের কর্মী। টানাটানির সংসারের দু’পয়সা বাঁচাতে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতে আলোও জ্বালানো হয় না।

Advertisement

এমন অন্ধকার থেকেই উঠে এসে এ বারের মাধ্যমিকে চতুর্থ স্থান দখল করেছে শৌভিক ভট্টাচার্য। লাভপুরের চৌহাট্টা হাইস্কুলের ওই ছাত্রের নম্বর ৬৮০। ছেলের সাফল্যে বাবা মনোরঞ্জনবাবু এবং মা সমাপ্তিদেবী দু’জনেই এ দিন আনন্দের কান্নায় ভেসেছেন। একই সঙ্গে ছেলের পরবর্তী পড়াশোনার খরচ নিয়ে চিন্তিত তাঁরা। শৌভিক জানিয়েছে, গণিত তার প্রিয় বিষয়। ভবিষ্যতে সে গণিত নিয়ে গবেষণা করতে চায়।

শৌভিকের বাবা-মায়ের মতোই সাধ আর সাধ্যের মধ্যের তফাতটা এখন বড্ড বেশি বিঁধছে আসানসোলের অসীম কুমারকে। তাঁর একমাত্র সন্তান রোহিত এ বারের মাধ্যমিকে ৬৭৮ পেয়ে ষষ্ঠ হয়েছে। বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন রোহিতের। কিন্তু এক চিকিৎসকের চেম্বারে সহকারী হিসেবে কাজ করে যা আয় হয় তাতে স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে দু’কামরার অ্যাসবেস্টসের ঘরে কষ্টেসৃষ্টে দিন গুজরান হয়। শুক্রবার ফল ঘোষণার সময় চেম্বারেই ছিলেন অসীমবাবু। খবরটা পেয়ে মিষ্টি কিনে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু মেধাবী, পরিশ্রমী ছেলেকে উচ্চশিক্ষা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার বানানো কি সহজ কথা! অসীমবাবুর ইচ্ছে, কোনও সহৃদয় মানুষের সাহায্য পাওয়া গেলে ছেলের সাধটা পূরণ করেন।

Advertisement

অনটনের পাহাড় ঠেলে স্বপ্নের পথ ধরে এগোচ্ছিল আরও এক কিশোরী। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আনন্দটাই বোঝা হল না তার!

গত সপ্তাহেই মায়ের সঙ্গে জল আনতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে জীবনতলার মুক্তারপুরের বাসিন্দা সুপর্ণা নস্কর (১৬)। শুক্রবার মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পরে দেখা গিয়েছে, ৫০৭ পেয়ে নিজের স্কুল ঈশ্বরীপুর মর্জিনা বিদ্যানিকেতনে প্রথম হয়েছে সুপর্ণা। সুপর্ণার কাকা সুশান্তবাবু ওই স্কুলেরই শিক্ষক। তিনিই ভাইঝির প্রথম হওয়ার খবরটা সকলকে জানান। কিন্তু কার পরীক্ষা, কার ফল, কীসের নম্বর! গত সপ্তাহের দুর্ঘটনা তো সব কেড়ে নিয়েছে নস্কর পরিবারের। সামান্য জমিজমা বন্ধক রেখে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে সুপর্ণাদের। মেধাবী মেয়েই ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র আশা। মেয়ের ফল জানার পরে সুপর্ণার মা কবিতাদেবী খানিকটা স্বগতোক্তির ঢঙেই বললেন, ‘‘আমার মেয়েটা সাংবাদিক হতে চেয়েছিল। সব শেষ!’’

সুপর্ণার মতো বাড়ির লোককে প্রথম থেকে পাশে পায়নি শেফালি। শুক্রবার তার জয়ের দিন। মাধ্যমিকে ৬৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে বাড়ির লোক, পাড়া-প্রতিবেশীকে শেফালি বোঝাতে পেরেছে, সে-ই ঠিক! কলকাতার ধাপা এলাকার বাসিন্দা শেফালি দাসের অমতেই বাড়ির লোক তার বিয়ে ঠিক করেছিল। বিয়ের আগের দিন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে ফোন করে বছর পনেরোর মেয়েটি জানিয়েছিল, সে পড়াশোনা করতে চায়। কাজ হয়েছিল সেই ফোনে। পুলিশ নিয়ে গিয়ে নাবালিকা কিশোরীকে উদ্ধার করে এনেছিল সংস্থাটি। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগে বিয়ে করতেই চায় না শেফালি। সিদ্ধান্তটা যে ভুল নয়, এ দিন সেটা প্রমাণ করতে পেরেছে সে।

দুঃস্বপ্নের সঙ্গে যুঝতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটাই যে একটা হাতিয়ার হতে পারে, সেটা বড় ভয়ানক ভাবে বুঝতে হয়েছে গাইঘাটার মেয়েটিকে। গত বছরের ১০ জানুয়ারি বই কিনে দেওয়ার জন্য মেয়েটিকে বাজারে ডেকেছিলেন বাবা। অভিযোগ, বাড়ি ফেরার পথে স্থানীয় দুই যুবক মাতা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। পরদিন পুলিশে অভিযোগ দায়ের করে মেয়েটি। পুলিশ তিন যুবককে গ্রেফতার করলেও এখন তারা জামিনে মুক্ত। মামলার শুনানি চলছে। আতঙ্কের কাছে মাথা না-নুইয়ে দাঁতে দাঁত চেপে পড়াশোনা করে যেতে হবে, বুঝেছে দরিদ্র ভাগচাষির সেই মেয়ে। এ বার মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে সে।

আলিপুরদুয়ার জংশনের রিয়া রায়ের লড়াই শুরু হয়েছে জন্মের পর থেকেই। কোমরের নীচের অংশ অসাড়। মাথাও স্বাভাবিকের তুলনায় বড়। পিঠের নীচে রয়েছে একটি টিউমার, যার বেশ খানিকটা অংশ চামড়ার বাইরে বেরিয়ে। হাইড্রো সেফালাস রোগের ফলে মস্তিষ্কে জল জমার সমস্যাও আছে। মেয়েকে সারিয়ে তুলতে নানা জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছেন রিয়ার বাবা। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান হেরে গেলেও জিতে গিয়েছে রিয়ার জেদ। এ বছর মাধ্যমিকে ৫৫২ নম্বর পেয়েছে সে। নিজের স্কুল জিৎপুর গার্লসে সে-ই প্রথম।

শারীরিক প্রতিকূলতার শিকার দেগঙ্গার বীণাপানি বালিকা বিদ্যালয়ের সায়নী এবং উপমা মণ্ডলও। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ওরা। মাসে একাধিকবার রক্ত নিতে হয়। সঙ্গে দোসর আর্থিক সঙ্কট। পরীক্ষার সময়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওদের পরে আলাদা করে পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সায়নী ৭২ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। উপমা পাশ করেছে দ্বিতীয় বিভাগে।

শুধু মাধ্যমিক নয়, জীবন-যুদ্ধেও জিতে গিয়েছে শৌভিক-রোহিত-সুপর্ণা-শেফালি-রিয়া-সায়নীরা।

একশোয় একশো বন্দিরা

মুক্ত জীবনের পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে যেটা এখনও সম্ভব হয়নি, লৌহকপাটের ভিতরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা সেটাই করে দেখালেন। তাঁরা একশোয় একশো।

নম্বরে না-হোক, পাশের শতাংশের নিরিখে রাজ্যের বিভিন্ন জেলে বসে মাধ্যমিক দেওয়া পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এটাই সত্য। জেল ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সূত্রের খবর, রাজ্যের পাঁচটি জেলে মহিলা ও পুরুষ মিলিয়ে মোট ৩০ জন এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এবং সকলেই পাশ করে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ‘এ’ গ্রেড পেয়েছেন পাঁচ জন।

জেলের খবর, ফলাফলের নিরিখে এ বারেও এক নম্বরে জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার। বন্দি পুরুষদের মধ্যে ৪৮৮ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছেন নিউ জলপাইগুড়ির ভক্তিনগরের বাসিন্দা উদয়ন মিত্র। মহিলাদের মধ্যে ৪৭১ নম্বর পেয়ে প্রথম জলপাইগুড়িরই তিতলিগুড়ির বাসিন্দা মালতী রাজভড়। দু’জনেই দণ্ডিত। গত বারেও বন্দিদের মধ্যে জলপাইগুড়ি জেল থেকেই প্রথম হয়েছিলেন বৈদ্য দাস। ওই জেলের সুপার শুভব্রত চট্টোপাধ্যায় জানান, এ বার সেখানে ১৫ জন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। আগামী বছর ওই জেল থেকে ৩৯ জন পরীক্ষা দেবেন।

এ বছর সারা রাজ্যের বিভিন্ন জেল থেকে মাধ্যমিকে বসা ৩০ জনের মধ্যে ২২ জন দণ্ডিত এবং আট জন বিচারাধীন বন্দি। পাঁচ জন ‘এ’ এবং ১৫ জন ‘বি+’ পেয়েছেন। ‘বি’ এবং ‘সি’ গ্রেড পেয়েছেন যথাক্রমে সাত এবং তিন জন বন্দি। কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলের মাওবাদী বন্দি বাপি মুদিও পাশ করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন