স্যারের পাশেই রোজ ভ্যালির ম্যাডাম

কোর্টের মুহুরি থেকে পুলিশের সেপাই— এত দিনে সবার চেনা ওই মুখ! বিচার ভবন-চত্বরে ঢাউস এসইউভি থেকে সানগ্লাসধারী নারীমূর্তির অবতরণ মাত্রই শুরু হয়ে যায় একটা ফিসফাস। সকলেই জানেন, আদালতে রোজ ভ্যালি কর্তা গৌতম কুণ্ডুর হাজিরা থাকলে তাঁকে দেখা যাবেই। পরনে সাধারণত কর্পোরেট-সুলভ সাদা ফুলশার্ট বা ক্যাজুয়াল জ্যাকেট-জিন্‌স। সানগ্লাস খোলার পর দেখা যায়, চোখে তাঁর সামান্য কাজল বা আই-লাইনার। এজলাসে ঢুকে একটা বিশেষ ‘পজিশন’ নেন তিনি। যেখান থেকে সোজাসুজি না হলেও তেরছা ভাবে দেখা যায় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো গৌতমকে।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৫ ০৩:৩৪
Share:

সীমা সিংহ। — নিজস্ব চিত্র।

কোর্টের মুহুরি থেকে পুলিশের সেপাই— এত দিনে সবার চেনা ওই মুখ!

Advertisement

বিচার ভবন-চত্বরে ঢাউস এসইউভি থেকে সানগ্লাসধারী নারীমূর্তির অবতরণ মাত্রই শুরু হয়ে যায় একটা ফিসফাস। সকলেই জানেন, আদালতে রোজ ভ্যালি কর্তা গৌতম কুণ্ডুর হাজিরা থাকলে তাঁকে দেখা যাবেই। পরনে সাধারণত কর্পোরেট-সুলভ সাদা ফুলশার্ট বা ক্যাজুয়াল জ্যাকেট-জিন্‌স। সানগ্লাস খোলার পর দেখা যায়, চোখে তাঁর সামান্য কাজল বা আই-লাইনার। এজলাসে ঢুকে একটা বিশেষ ‘পজিশন’ নেন তিনি। যেখান থেকে সোজাসুজি না হলেও তেরছা ভাবে দেখা যায় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো গৌতমকে।

বুধবারের বিকেল। এজলাস থেকে বেরোনোর সময়ে সেই নারীমূর্তির দিকে তাকালেন ধ্বস্ত চেহারার গৌতম। দেখা গেল, মুখে একটা স্মিত ভাব ফুটিয়ে ‘স্যার’কে চোখে-চোখেই সাহস জোগালেন কাজলনয়না।

Advertisement

তিনি, সীমা সিংহ।

রোজ ভ্যালি-র নামাঙ্কিত ১৪টি সংস্থার ডিরেক্টর হিসেবে নাম রয়েছে মধ্য তিরিশের এই মহিলার। অনেকেই বলেন, গৌতম জেলে যাওয়ার পরে সংস্থার ভাঙা নৌকো সচল রেখেছেন এই সীমাই। বলতে গেলে, তাঁরই মুখের দিকে এখন তাকিয়ে সংস্থার ছাপোষা এজেন্ট-কর্মীরা। আর সীমা সংস্থা সামলানোর পাশাপাশি চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁর ‘স্যার’কে গারদ থেকে বের করে আনার। বলছেন, ‘‘কোম্পানিটা বাঁচাতে হবে! স্যারকে জামিনে বার করে আনতে হবে। এটাই লক্ষ্য।’’

কে এই সীমা সিংহ?

রোজ ভ্যালিতে এখন যাঁর নামে আলাদা ‘ডিরেক্টর আইডেন্টিফিকেশন নম্বর’ ধার্য হয়েছে? গৌতম গ্রেফতার হওয়ার পরে সংস্থার চেকেও যাঁর সই থাকছে? এমনিতেও দু-তিনটি বাদে রোজ ভ্যালির সব-ক’টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ‘সিল’ হয়ে গিয়েছে। সব
চেক চালাচালি সীমারই নজরদারিতে।

এ হেন সীমার রোজ ভ্যালি সাম্রাজ্যে উত্থান তৃণমূল স্তর থেকেই।

মোটে কয়েক বছর কল সেন্টারে কাজের অভিজ্ঞতা পুঁজি করেই রোজ ভ্যালিতে ইনিংস শুরু তাঁর। সেটা ২০০৯-এর অগস্ট। তখন মোটে ক’হাজার টাকা মাইনে পেতেন সীমা। রোজ ভ্যালির কর্মীদের ‘সফ্‌ট স্কিল’ বা ইংরেজিতে কথা বলা, কর্পোরেট আদব-কায়দা শেখানোই ছিল তাঁর কাজ। সেখান থেকেই উপরে উঠেছেন রীতিমতো উল্কার গতিতে। এক সময়ে রোজ ভ্যালির ‘এইচআর’ বা মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্বভার তাঁর কাঁধে বর্তেছে। ক্রমশ দেখা গিয়েছে, সংস্থায় সীমার সিনিয়র, এমডি শিবময় দত্তের চেয়েও সীমার সিদ্ধান্তকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন রোজ ভ্যালি চেয়ারম্যান। মাত্র পাঁচ বছরে এই ‘আস্থাভাজনে’র মাইনেও বেড়েছে দশ গুণের বেশি। বাগুইআটির বাড়িতে স্বামী ও এক সন্তানের সংসারে তাঁর হাত ধরেই এসেছে সমৃদ্ধির ছোঁয়া।

আর এখন সংস্থার অসময়েও গৌতমের প্রধান ভরসা সীমা। এতটাই যে, পুলিশ-মুহুরিদের একাংশ তাঁকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন, ‘‘ওই যে রোজ ভ্যালি-র দেবযানী এল!’’

সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের ডানহাত দেবযানীর সঙ্গে সীমার তুলনা উচিত কি না, তা অবশ্য তর্কের বিষয়। কারও কারও মতে, সাধারণ কর্মীর স্তর থেকে উঠে এসে একেবারে কর্ণধারের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ঢুকে পড়ার গল্পটা সীমা-দেবযানী দু’জনের ক্ষেত্রেই এক। সম্ভবত সেই কারণেই সীমার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে এই ডাকনাম। যদিও দু’জনের অমিলও যথেষ্ট। সব চেয়ে বড় কথা, সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে দেবযানী রয়েছেন জেলে। আর সীমার নামে এখনও পর্যন্ত কোনও আইনি অভিযোগ উঠেছে বলে খবর নেই। তা ছাড়া, ধরা পড়ার পর সুদীপ্তের কুকীর্তিতে তাঁর কোনও দায় নেই বলে সরব হয়েছিলেন দেবযানী। কিন্তু সীমা যেন রোজ ভ্যালি-কর্তার জেলযাত্রার পরে আরও বেশি করে সংস্থার ভাল-মন্দে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

রোজ ভ্যালি সূত্রের খবর, ‘সীমা ম্যাডাম’ এখন সংস্থার ‘লিগ্যাল সেল’-এরও দায়িত্বে। তাই রোজ আদালতে এসে মামলার গতি-প্রকৃতি খুঁটিয়ে খেয়াল রাখছেন (ফুরসত বুঝে নাকি আদালতে ‘স্যার’-এর সঙ্গে একান্তে টুকটাক কথাও বলছেন তিনি)। রোজ ভ্যালি কর্তার আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও মাঝেমধ্যে পরামর্শ করতে দেখা যাচ্ছে সীমাকে। শোনা যাচ্ছে, গৌতমের মুশকিল আসানে মুম্বইয়ে সলমন খানের সঙ্কটমোচনকারী আইনজীবীকেও উড়িয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।

নিন্দুকেরা অবশ্য বলছেন, এই সবই সুযোগ বুঝে ক্ষমতা মুঠোয় ভরার ছক। রোজ ভ্যালিরই কেউ কেউ এই ভরাডুবির জন্য আঙুল তুলেছেন সীমার দিকে। তাঁর চমকপ্রদ উত্থান নিয়ে বক্রোক্তিও করেছেন। আর সীমা?
হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘দেখিয়ে, ইয়ে সব প্রফেশনাল জেলাসি। ওরা পারেনি, তাই এ সব বলছে!’’ বাংলা-ইংরেজি-হিন্দির মিশেলে তুখোড় তিনি। সদ্য পরিচিত সাংবাদিককে কেটে-কেটে বললেন, ‘‘আমি জানি, কারা আমায় নিয়ে কী খবর ছড়াচ্ছে! কিন্তু আমি নিজের কাছে পরিষ্কার!’’ সীমার সাফ কথা— তিনি যেটুকু অর্জন করেছেন, যোগ্যতায় করেছেন। যা করছেন, কোম্পানির ভালর জন্যই করছেন!

স্পষ্টতই কোনও ‘ডাকনামে’ তাঁর কিছু যায়-আসে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন