বিরল রোগের সচেতনতায় সরকার কই

কিন্তু সমস্যা হল, পাঠ্যক্রমে বিরল রোগের বিষয়টি না থাকায় মুশকিলে পড়তে হয় ডাক্তারদের।

Advertisement

জয়তী রাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৫৬
Share:

প্রতীকী ছবি।

জড়িয়ে যাওয়া কথায় প্রিয় গানের সুর উঠত না। আঙুল নিয়ন্ত্রণে না থাকায় হারমোনিয়াম বাজাতে কষ্ট হত। ২০১৭-র ২৭ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর দেড় মাস আগেও প্রাণপণে যন্ত্রণা ভুলে থাকার চেষ্টা করতেন বছর চব্বিশের দেবনীল পাল। তার দু’বছর আগে পরিবার জানতে পারে, ‘নিম্যান পিক, টাইপ সি’ রোগে আক্রান্ত তিনি। মূলত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কোষে লিপিড (ফ্যাট) জমে এই অসুখ হয়।

Advertisement

বিরল এই রোগের ওষুধ তৈরি করে বিদেশি একটিই সংস্থা। অন্তত পরীক্ষামূলক ভাবেও সেই ওষুধ যাতে দেবনীল পান, তার চেষ্টায় খামতি ছিল না পাটুলি টাউনশিপের বাসিন্দা ওই পরিবারের। প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী— যোগাযোগ করা হয়েছিল সর্বস্তরে। ওই তরুণের মৃত্যুর তিন মাস পরে কেন্দ্র চিঠি দিয়ে জানায়, চিকিৎসায় সরকার সাহায্য করতে পারবে না। দেবনীলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে দীর্ঘ বারো বছর বারবার এমনই অসহযোগিতা পেয়েছে পাল পরিবার।

কর্মসূত্রে ভিয়েতনামের বাসিন্দা দেবনীলের দিদি রিহা পাল জানাচ্ছেন, হঠাৎই চঞ্চল হয়ে উঠেছিল তাঁর ১২ বছরের ভাই। সারা দিন ক্রিকেট খেলত। দেবনীলের যখন ১৪-১৫ বছর বয়স, তখন থেকে ভুলতে শুরু করে। বহু চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেও কোনও কারণ জানা যায়নি। রিহা বলেন, “আমার কাছ থেকেই ওর গান শেখা। শাস্ত্রীয় ও রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব পছন্দ করত।” তাঁর আক্ষেপ, “ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় ন্যূনতম পরামর্শ পাইনি। বেঙ্গালুরুতে স্নায়ুরোগের এক চিকিৎসা-কেন্দ্রে প্রথম অসুখটার নাম শুনি। বিরল রোগ নিয়ে বিদেশে সরকার এবং রোগীর পরিবারের সচেতনতা অনেক বেশি। আমার প্রশ্ন, আর কত অমানবিকতার সাক্ষী থাকবে আমাদের মতো পরিবার?”

Advertisement

মলিকিউলার জেনেটিক্স বিজ্ঞানী দীপাঞ্জনা দত্তের মতে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পাশাপাশি চিকিৎসকদের বিরল রোগ নিয়ে আরও সংবেদনশীল ও সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, “বিশ্বে সাত হাজার বিরল রোগের মধ্যে কয়েকশোর হদিস মিলেছে ভারতে। কলকাতার চিকিৎসকদের অনেকেরই বিরল রোগ নিয়ে ধারণা নেই। অধিকাংশ রোগের কোনও চিকিৎসা নেই। তাই কোন কোন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, সেগুলি পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। দরকার পরিবার ও রোগীর কাউন্সেলিং, বিভিন্ন থেরাপির ব্যবস্থা করা।”

কিন্তু সমস্যা হল, পাঠ্যক্রমে বিরল রোগের বিষয়টি না থাকায় মুশকিলে পড়তে হয় ডাক্তারদের। শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের বক্তব্য, ওই পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের সময় এসেছে। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যয়বহুল পরীক্ষায় এই ধরনের রোগ ধরা পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ পরিবারের সেই পরীক্ষা করার মতো আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তাঁরা চিকিৎসা চালাতে পারেন না। যদি বা রোগ ধরা পড়ল, তার সাপোর্ট ম্যানেজমেন্টের সংগঠিত ব্যবস্থা এ শহরে প্রায় নেই। এই ছবি বদলাতে এক ছাদের নীচে পরিকাঠামো গড়তেই হবে সরকারকে।’’

আজ, ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘ওয়ার্ল্ড রেয়ার ডিজিজ় ডে’। একজোট হয়ে লড়াইটা বছরভর চললেও ওদের জন্য থাকুক একটি দিন— মানছেন স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি (এসএমএ) আক্রান্ত আট বছরের দেবস্মিতার মা মৌমিতা ঘোষ এবং হান্টার সিন্ড্রোমের শিকার আরিয়ানের বাবা শিবশঙ্কর চৌধুরী। এই জোট বাঁধার ফল ‘কিওর এসএমএ ফাউন্ডেশন, ইন্ডিয়া’। যার পূর্ব ভারতের কো-অর্ডিনেটর মৌমিতা নিজে। তিনি জানালেন, এসএমএ আক্রান্ত পরিবারগুলির মধ্যে যোগাযোগ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি সরকারি স্তরে আলোচনাও চালায় এই সংগঠন। অন্য দিকে, লড়াইয়ের আর এক মুখ শিবশঙ্কর। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় আজ পরীক্ষামূলক ভাবে ওষুধ পাচ্ছে ছেলে আরিয়ান।

এই লড়াকু মানসিকতাই প্রয়োজন, মনে করছেন অর্গানাইজেশন অব রেয়ার ডিজিজ়েস, ইন্ডিয়ার এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর প্রসন্ন শিরোল। তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়ে পম্পি রোগে আক্রান্ত। প্রসন্ন বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য বিমায় বিরল রোগকে অন্তর্ভুক্ত করা ও সরকারি পরিকাঠামো তৈরি করাই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য। সে কাজে সামান্য সাফল্য এসেছে। কর্নাটক সরকার বিরল রোগের জন্য পৃথক পরিকাঠামো তৈরি করেছে। তবে সামনের লড়াইটা আরও দীর্ঘ।’’

কী ভাবছে রাজ্য সরকার? স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ছ’মাস আগে এ নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। তবে তা একেবারেই প্রাথমিক স্তরে।’’

মৌমিতা-শিবশঙ্করেরা জানেন চূড়ান্ত পরিণতি। তবুও আশা, ‘‘আমাদের সন্তান যেন একটু ভাল ভাবে বাঁচে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন