আলু নিয়ে বিতর্ক জারি

বিকল্প চাষে উৎসাহ দেবে রাজ্য সরকার

রাখলেও আলু চাষ, মারলেও— ফি বছর এই মানসিকতা নিয়ে চলছেন এ রাজ্যের কৃষিজীবীদের একটা বড় অংশ। প্রত্যাশিত লাভ না হতেই তাঁরা বিক্ষোভ-অবরোধের রাস্তায় হেঁটে সরকারকে সহায়ক মূল্যে আলু কেনার পথে ঠেলতে চাইছেন। জটিলতা বাড়ছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষিজীবী পরিবারে আত্মহত্যায়।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৫ ০৩:২৪
Share:

রাখলেও আলু চাষ, মারলেও— ফি বছর এই মানসিকতা নিয়ে চলছেন এ রাজ্যের কৃষিজীবীদের একটা বড় অংশ। প্রত্যাশিত লাভ না হতেই তাঁরা বিক্ষোভ-অবরোধের রাস্তায় হেঁটে সরকারকে সহায়ক মূল্যে আলু কেনার পথে ঠেলতে চাইছেন। জটিলতা বাড়ছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষিজীবী পরিবারে আত্মহত্যায়। সোমবারেও পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনায় এক আলু চাষির ঝুলন্ত দেহ মিলেছে। এই আবহে বিকল্প চাষে চাষিদের উৎসাহিত করা হবে বলে সোমবার ঘোষণা করেছেন কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। যদিও বিতর্ক তাতে থামেনি। বরং প্রশ্ন উঠেছে, গত দুই মরসুমে আলু নিয়ে কৃষিজীবীদের সমস্যার কথা জেনেও বিকল্প চাষের বিষয়টিকে কেন আগে সে ভাবে তুলে ধরা হল না? শাসক দল আবার পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে, বিকল্প চাষ জনপ্রিয় করার বিষয়ে বিরোধী কৃষক সংগঠনগুলি তৎপর হয়নি কেন।

Advertisement

রাজ্যে এ বার ১ কোটি ২০ লক্ষ টন আলু ফলেছে। অথচ, সরকারি হিসেবে রাজ্যে মাত্র ৭৪ লক্ষ টন আলু হিমঘরে সংরক্ষণ করা যায়। ফলে, দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। কৃষি দফতরের দাবি, এ তথ্য চাষিদের অজানা নয়। অথচ, তাঁরা আলুর বদলে অন্য কিছু চাষ করার ঝুঁকি নিতে নারাজ। ডাল, বাদাম, তিলের মতো বিকল্প চাষে আগ্রহ দেখান না। পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনার মাধবপুরের চাষি তপন সামন্ত, মনোহরপুর পঞ্চায়েতের অভিরাম ঘোষ, বান্দিপুরের অচিন্ত্য সরকারেরা মেনেও নিচ্ছেন সে কথা। বলছেন, “আসলে সব জমিতে আলুর বদলে বিকল্প চাষ করার মতো পরিবেশ বা মানসিকতা তৈরি হয়নি। কিছু চাষি আলুর সঙ্গে প্রয়োজনে মুগ বা বাদাম চাষ করেন। কিন্তু লোকসানের মুখেও আলু ছেড়ে অন্য কোনও চাষের কথা ভাবনাতেই আনতে পারেন না।”

এই পরিস্থিতিতে চলছে বিক্ষোভ। এ দিন আলিপুরদুয়ারে হিমঘরের সংখ্যা ও সহায়ক মূল্য বাড়ানোর দাবিতে জেলাশাসকের দফতরের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে। রবিবার বর্ধমানের শক্তিগড়ে ২ নম্বর জাতীয় সড়কে অবরোধ করে বামফ্রন্ট।

Advertisement

কৃষিমন্ত্রী জানান, পরিস্থিতি মোকাবিলায় এ বার সোনা মুগ, মুসুর, অড়হড়, খেসারির মতো ডাল এবং সূর্যমুখীর চাষ বাড়াতে সচেষ্ট হয়েছে তাঁর দফতর। তাঁর কথায়, “আলু চাষে চাষিরা যে পয়সা পান, তার থেকে বেশি টাকা ডাল চাষ করলে পাওয়া যাবে। ডাল চাষ করলে কৃষি দফতর কৃষকদের উন্নত মানের ডাল-বীজ, প্রয়োজনীয় সার, প্রশিক্ষণসবই দেবে। সূর্যমুখী চাষের সঙ্গে যুক্ত কৃষকদের তেল তৈরির যন্ত্র দেওয়া হবে। এই বিষয়টি মাথায় ঢুকলে, চাষিদেরই ভাল।”

গত দু’বছর ধরেই এ রাজ্যে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আলু উৎপাদিত হয়েছে। প্রায় চার বছর আগে ক্ষমতায় আসা রাজ্য সরকার বিকল্প চাষের গুরুত্ব এত দিনে বুঝতে পারল? মন্ত্রীর জবাব, “আলুচাষিরা এখন দাবি করছেন উৎপাদিত পণ্যের দাম পাচ্ছেন না। তাই বিকল্প চাষে রাজ্য সরকার জোর দিতে চাইছে।”

যদিও সরকারি যুক্তি মানতে নারাজ বাম আমলের কৃষি বিপণন দফতরের চেয়ারম্যান নরেন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “উৎপাদন হয়ে যাওয়ার পরে ভাবলে চলবে না। আলু উৎপাদনের আগেই সরকারকে বিকল্প চাষের ক্ষেত্র তৈরি করে হবে।” বাম চেয়ারম্যান বিমান বসুর দাবি, রাজ্য সরকারকে আট টাকা কেজি দরে আলু কিনতে হবে। বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার দাবি, ‘স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কিং কমিটি’র সঙ্গে বৈঠকে বসে মুখ্যমন্ত্রীর উচিত, আলু চাষিদের ঋণের সুদ মকুবের ব্যবস্থা করা। বিমানবাবু এবং মানসবাবুর অভিযোগ, সরকার চাষিদের আত্মহত্যার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে চাইছে না। বিমানবাবু বলেছেন, “আলু চাষিদের আত্মহত্যা করলে হবে না। রুখে দাঁড়াতে হবে। রাস্তাকেই রাস্তা (প্রতিবাদের পথ) হিসাবে বেছে নিতে হবে।”

অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়ের জিজ্ঞাসা, “৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা বামেরা তা হলে বিকল্প চাষে এ রাজ্যের চাষিদের উৎসাহী করে তুলতে পারেননি কেন? তাঁরা তো পরিস্থিতিটা চাষিদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারতেন। তা না করে উল্টে রাস্তা অবরোধ করে মানুষকে বিপদে ফেলে ঘোলা জলে মাছ ধরছেন।” নরেনবাবুর জবাব, “বিকল্প চাষে চাষিদের উৎসাহী করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু নদিয়া, জলপাইগুড়ি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের একটা অংশ বাদে অন্যত্র বিকল্প চাষের উদ্যোগ সফল হয়নি।”

কেন সফল হল না ওই উদ্যোগ? কৃষি দফতরের মাঠেঘাটে ঘুরে কাজ করা আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গিয়েছে একাধিক যুক্তি। বর্ধমানের এক কৃষি আধিকারিক জানান, বিকল্প চাষের প্রসার তখনই ঘটে, যখন এলাকায় কৃষিজ পণ্যভিত্তিক শিল্প এবং তার বাজার গড়ে ওঠে। যেমন, পূর্বস্থলীতে এক দশক আগে বহু চাষি পেয়ারা চাষে উৎসাহে নেমেছিলেন। তবে উৎপাদিত পণ্যের বাজার না থাকায় তাঁরা হতোদ্যম হয়ে পড়েন। একই সমস্যায় ভুগছে পূর্বস্থলীতে ফুল, ফলের চারা চাষ। কোচবিহারের এক কৃষিকর্তার বক্তব্য, “যে চাষে লাভের সম্ভাবনা আছে, ঝুঁকি থাকলেও সেই চাষের প্রতি আকর্ষণ থাকে। আলু তেমনই একটা চাষ। হাজার বুঝিয়েও চাষিদের নিরস্ত করা যাচ্ছে না।”

এই আবহে এ দিন সকালে চন্দ্রকোনায় অনুপ ঘোষাল (৩৮) নামে এক আলুচাষির ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় বাড়ির অদূরে গোয়ালঘর থেকে। চন্দ্রকোনা থানার ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা অনুপ বিঘা চারেক জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। পরিবার সূত্রে খবর, চাষের জন্য মহাজনের থেকে টাকা ধার করেছিলেন অনুপ। স্ত্রী নীলিমা ঘোষালের গয়না বন্ধক রেখে খেতমজুরের খরচ মিটিয়েছিলেন। প্রায় ৮০ হাজার টাকা ধার ছিল তাঁর। অনুপের মামা অশোক ঘোষের দাবি, “আলুর দাম পায়নি ভাগ্নে। ধার শোধ হবে কী ভাবে, সেই চিন্তায় ও আত্মহত্যা করে।”

চন্দ্রকোনা-১ ব্লকের বিডিও সুরজিৎ ভড় বলেন, “ঠিক কী কারণে এই চাষির মৃত্যু হয়েছে, তা জানতে তদন্ত শুরু হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন