চিকিৎসকদের ‘মানবিক’ হতে শেখাচ্ছে সরকার

হাসপাতালে কোনও রোগীর মৃত্যু হলে তার প্রাথমিক ধাক্কায়, শোকে ও হতাশায় আত্মীয়-পরিজন ক্ষুব্ধ হতে পারেন, উত্তেজিত হতে পারেন। ক্ষণিকের জন্য তাঁদের মনে হতে পারে, হয়তো চিকিৎসায় কোথাও ফাঁক ছিল বলেই এমন হল। পরিস্থিতির ফায়দা নিয়ে হাসপাতালের এক শ্রেণির দালাল বা গুন্ডাও সেই উত্তেজনায় ইন্ধন জোগাতে পারেন।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৬ ০০:৫৩
Share:

ডেপুটি সুপারকে নির্দেশ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার, পিজি-তে। — নিজস্ব চিত্র

হাসপাতালে কোনও রোগীর মৃত্যু হলে তার প্রাথমিক ধাক্কায়, শোকে ও হতাশায় আত্মীয়-পরিজন ক্ষুব্ধ হতে পারেন, উত্তেজিত হতে পারেন। ক্ষণিকের জন্য তাঁদের মনে হতে পারে, হয়তো চিকিৎসায় কোথাও ফাঁক ছিল বলেই এমন হল। পরিস্থিতির ফায়দা নিয়ে হাসপাতালের এক শ্রেণির দালাল বা গুন্ডাও সেই উত্তেজনায় ইন্ধন জোগাতে পারেন। কারণ, তাতে সকলের সামনে হাসপাতালে তাঁদের ক্ষমতা কত, সেটা জাহির করার একটা মওকা পাওয়া যায়।

Advertisement

কিন্তু এমতাবস্থায় চিকিৎসকদের কর্তব্য কী হবে? মৃতের পরিজন উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করলে চিকিৎসকেরাও কি পাল্টা মেজাজ হারাবেন? বাঁশ বা হকি স্টিক হাতে নিয়ে ধাক্কাধাক্কি-মারামারি শুরু করে দেবেন? নাকি সেই জটিল, স্পর্শকাতর মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করবেন? সহানুভূতি আর মানবিকতা দিয়ে রোগীর পরিজনদেরও শান্ত করবেন?

এসএসকেএম হাসপাতালে গত সোমবার গভীর রাতে এক রোগীর মৃত্যুকে ঘিরে অশান্তির পরে মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কর্তৃপক্ষকে কড়া বার্তা দিয়ে বলেন, ‘‘বারবার অভিযোগ উঠছে। ভাল ব্যবহার করুন। যাঁরা ডাক্তার হচ্ছেন, তাঁদের ভাল ব্যবহার শেখান। এক শতাংশও খারাপ ব্যবহার কেন করবেন? যাঁদের আত্মীয় মারা যান, তাঁদের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করুন। ঠান্ডা মাথায় তাঁদের বোঝান। আমি কিন্তু ব্যাপারটা খুব সিরিয়াসলি দেখে গেলাম। টেক কেয়ার।’’

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রী একটা মন্তব্য করে গিয়েছেন, দু’দিন পরেই সবাই বিষয়টা ভুলে যাবেন— এ ক্ষেত্রে অন্তত তেমন ভাবছেন না চিকিৎসকেরা। কারণ, মুখ্যমন্ত্রীর এই মুখে বলারও কয়েক মাস আগে তাঁর স্বাস্থ্য দফতর রীতিমতো আট সদস্যের কমিটি গড়ে সরকারি চিকিৎসকদের রোগী ও তাঁর বাড়ির লোকের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা, চাপের মুখে মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা এবং সহানুভূতি-সহমর্মিতার সঙ্গে রোগী ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে আলোচনার পাঠ দিতে শুরু করেছে। রোগীর পরিবারের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করাই এই প্রশিক্ষণের অন্যতম প্রধান বিষয়।

চিকিৎসকদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়া কতটা জরুরি, এসএসকেএমের ঘটনার পরে তা স্বীকার করেছেন মন্ত্রী তথা ওই হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়্যারম্যান ফিরহাদ হাকিম। মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘‘যিনি ডাক্তারবাবুকে দেবতা মনে করে পায়ে পড়ছেন, প্রিয়জনের মৃত্যুর পরে তিনিই হয়তো দিশাহারা হয়ে ডাক্তারের কলার ধরছেন। তখন কী করে তাঁকে সামলাতে হবে, সেটা তো ডাক্তারবাবুকে শিখতে হবে। সিনিয়র চিকিৎসকদের এটা শেখানো উচিত জুনিয়রদের। ডাক্তারদেরই বুদ্ধি ও মানবিকতার সঙ্গে এমন অবস্থা তৈরি করতে হবে, যেখানে মারার বদলে রোগীর আত্মীয়েরা ডাক্তারের কাঁধে মাথা রেখেই কাঁদেন।’’

স্বাস্থ্য দফতরের যে কমিটি জুন মাস থেকে এই প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তার চেয়ারম্যান রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ছাড়া কমিটিতে আছেন ‘ইনস্টিটিউট অব হেল্‌থ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার’-এর অধিকর্তা কৃষ্ণাংশু রায়, চিকিৎসক শিবার্জুন ঘোষ, সুগত দাশগুপ্ত, ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী প্রমুখ। সুশান্তবাবুই জানান, এই এসএসকেএমেই কিছু দিন আগে অল্পবয়সী একটি মেয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছিল। সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো যাবে না, বুঝেছিলেন চিকিৎসকেরা। সেই সত্যিটা বাড়ির লোককে ধৈর্য আর সহানুভূতির সঙ্গে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। বোঝাতে পেরেওছিলেন। কেউ চিকিৎসা গাফিলতির অভিযোগ এনে অশান্তি বাধাননি। মেয়েটির মৃত্যুর পরে শ্রাদ্ধবাসরে বাড়ির লোক চিকিৎসকদের এবং হাসপাতালের একাধিক কর্তাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।

খারাপ খবর কী ভাবে রোগী বা তাঁর পরিবারকে বলা হবে বা খারাপ পরিস্থিতিতে কেমন ব্যবহার করা উচিত, সেটা যে চিকিৎসা শেখার মতোই গুরুত্বপূর্ণ, তা মেনে নিয়েছে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া-ও। তাই আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই তারা চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীর সংযোগ বাড়ানোর পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করছে এমবিবিএসে। তার আগে প্রতিটি রাজ্যে শিক্ষক-চিকিৎসকদের এই সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করতে বলা হয়েছে। কারণ পরবর্তীকালে এই প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট বা অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরেরাই এমবিবিএস পড়ুয়াদের তা শেখাবেন।

গত দু’মাসে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এই প্রশিক্ষণ দিয়েছে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের ৫৩ জন শিক্ষক-চিকিৎসককে। সেপ্টেম্বরে প্রশিক্ষণ নেবেন আরও ২৫ জন। স্বাস্থ্য দফতরের আট জনের যে কমিটি এই প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তার প্রত্যেক সদস্যই চলতি বছরের গোড়ায় লখনউয়ে এমসিআই-এর পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। ওই সদস্যদের অন্যতম কৃষ্ণাংশু রায়ের কথায়, ‘‘একেবারে স্ক্রিপ্ট লিখে সিনিয়র শিক্ষক-চিকিৎসকদের সামনে অভিনয় করে দেখাচ্ছি আমরা। হাসপাতালের বিভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করে কী করে ডাক্তারবাবুরা মানবিক ভাবে, সহানুভূতির সঙ্গে সামলাবেন— তা অভিনয় করে দেখানো হচ্ছে।’’

কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতাল রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট’-এর দু’বছরের ডিগ্রি কোর্স চালায়। বছর পাঁচেক আগে তাদের তরফে স্বাস্থ্য দফতরের কাছে একটি আবেদন গিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য দফতর চিকিৎসক ও হাসপাতালের চিকিৎসক-প্রশাসকদের এই কোর্স করতে পাঠাতে পারে। সে সময়ে এতে আগ্রহ দেখাননি স্বাস্থ্যকর্তারা। কিন্তু তাঁদেরই একটা বড় অংশ এখন মানছেন, প্রতিদিন হাসপাতালে ঝামেলা, রোগীর বাড়ির লোকের সঙ্গে চিকিৎসকদের ঝামেলা, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে নাজেহাল হয়ে বোঝা যাচ্ছে, ‘ম্যান ম্যানেজমেন্ট’-এর পাঠ নেওয়াটাও চিকিৎসকদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্তবাবুর ব্যাখ্যায়, প্রতিদিন রোগীর বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলা, তাঁদের অভাব-অভিযোগ শোনা, খারাপ খবর জানানোর আগে পরিজনদের সহানুভূতির সঙ্গে কাউন্সেলিং করা, নমনীয় ভাবে দুঃখপ্রকাশ করা, রোগীকে গায়ে-মাথায় স্পর্শ করে দেখা, একটু হাসিমুখে ভালবেসে কথা বলা— এতেই জটিল পরিস্থিতি ম্যাজিকের মতো বদলে যায়। হাতাহাতি করতে হয় না। সেটাই ডাক্তারবাবুদের শেখানো হচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত মুন্নাভাইয়ের ‘জাদু কি ঝাপ্পি’র গুরুত্ব বুঝেছে স্বাস্থ্য দফতর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন